সম্প্রতিই আবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু করেছে জ্বালানি বিভাগ। ইতিমধ্যে ডিজেল ও কেরোসিনের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধি দেশের অর্থনীতি ও জনজীবনে বড় আঘাত হানে। তবে সেদিকে লক্ষ্য না করেই সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের পরামর্শে গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোও দাম বাড়ানোর প্রস্তাব তৈরি করেছে।
কয়েকটি কোম্পানি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) প্রস্তাব জমাও দিয়েছে। বলা হচ্ছে, ‘ভর্তুকির চাপ’ সামলাতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের ভুল নীতি আর সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। জনগণকে সেই ভর্তুকির বোঝা টানতে হচ্ছে বছরের পর বছর।
গত ১১ বছরে ১০ বার সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। এ সময়ে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বেড়েছে ১১৮ শতাংশ। খুচরা পর্যায়ে বেড়েছে ৯০ শতাংশ। আর ২০১৯ সালের ১ জুলাই সর্বশেষ গ্যাসের দাম বাড়ে। আবাসিক খাতে দুই চুলার খরচ ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৭৫ টাকা করা হয়। বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন, হোটেল-রেস্তোরাঁ, ক্যাপটিভ পাওয়ার, শিল্প ও চা বাগানে ব্যবহূত গ্যাসের দাম গড়ে ৩২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ বাড়ে।
সরকারের ভুল নীতি
গ্যাস খাতের পরিকল্পনায় অন্তত তিনটি বড় ভুলের তথ্য পাওয়া গেছে। প্রথমত, আমদানির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অনুপাতে কোনো দেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি না করে স্পট মার্কেট থেকে বেশি বেশি গ্যাস কেনা। দ্বিতীয়ত, দেশে গ্যাস অনুসন্ধান প্রায় বন্ধ রাখা এবং তৃতীয়ত, ব্যবসা একক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে চলতে দেওয়া।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম জানান, দেশে গ্যাস অনুসন্ধান প্রায় বন্ধ। স্থলভাগে তেমন নজর দেওয়া হচ্ছে না। আর সাগরে অনুসন্ধানের কোনো উদ্যোগই নেই।
বিকল্প হিসেবে সরকার এলএনজির আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এ বিষয়ে অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, গ্যাস সংকট জিইয়ে রেখে এলএনজির ব্যবসার দ্বার খোলা হয়েছে।
সরকারঘনিষ্ঠ এক ব্যবসায়ী একের পর এক এলএনজি ব্যবসা কুক্ষিগত করছেন। গ্যাস অনুসন্ধানের তহবিল এলএনজি আমদানিতে খরচ করা হয়েছে। গত এক বছরে এ তহবিল থেকে এলএনজির জন্য ৯ হাজার কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে।
দেশের দুই এলএনজি টার্মিনাল বছরে ৭০ লাখ টন এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশন (প্রক্রিয়াকরণ) করতে পারে। কিন্তু কাতার ও ওমানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে বছরে সর্বোচ্চ ৪০ লাখ টন এলএনজি সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। বিপরীতে সরকার আমদানির ৭০ শতাংশ এলএনজি কিনছে স্পট মার্কেট থেকে।
অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, স্পট মার্কেট থেকে এত বেশি পরিমাণ এলএনজি কোনো দেশ কেনে না। কারণ, স্পট মার্কেট অত্যন্ত অস্থির। এ মার্কেট থেকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ এলএনজি কেনা উচিত ছিল, আর ৯০ শতাংশ কেনা উচিত ছিল একাধিক দেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে। তাহলে এখন এলএনজির বাজার ঊর্ধ্বমুখী হলেও লোকসান তেমন বাড়ত না।
বিদ্যুতের ক্ষেত্রে অন্তত দুটি ভুল নীতির কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা। প্রথমত, প্রয়োজনের তুলনায় বেশি উৎপাদন সামর্থ্য দেখিয়ে বসে থাকা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে খরচ (ক্যাপাসিটি চার্জ) দেওয়া এবং অপচয়ের বিপুল সুযোগ তৈরি করা ও জিইয়ে রাখা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং নীতিনির্ধারকদের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ব্যয় বাড়ছে। এতে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে রাষ্ট্রের।
চাহিদা না থাকায় দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার এক-তৃতীয়াংশই বসিয়ে রাখতে হয়। বিদ্যুৎ না কিনলেও উদ্যোক্তাদের চুক্তি অনুসারে প্রতি মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে শত শত কোটি টাকা দিতে হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে পিডিবির খরচ হয়েছে ১৩ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা। এ সময়ে সংস্থাটির নিট লোকসান হয়েছে ১১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
কয়েক হাজার কোটি টাকার লাভ
যদিও গ্যাস ও বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই লাভজনক। তারা প্রতিবছর সরকারি কোষাগারে কয়েক হাজার কোটি টাকা জমা দিচ্ছে।
উদ্বৃত্ত অর্থ, ট্যাক্স-ভ্যাট ও বিভিন্ন ফি হিসেবে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাত থেকে আয় করেছে সরকার।
সরকারি কোম্পানিগুলো শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশও দিয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-বোনাসও বাড়ছে প্রতিবছর।
বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানের তহবিলে জমা আছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে পিডিবির স্থিতির পরিমাণ ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এখান থেকে সরকার নিয়েছে দুই হাজার কোটি টাকা।
পেট্রোবাংলার বিভিন্ন তহবিলে ওই অর্থবছরে স্থিতি ছিল ১৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা। সরকার নিয়েছে চার হাজার কোটি টাকা। পিডিবি গত অর্থবছরে ট্যাক্স, ভ্যাট ও নানা ফি বাবদ সরকারি কোষাগারে দিয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। পেট্রোবাংলা দিয়েছে ৮০০ কোটি টাকা।
ডিপিডিসি গত অর্থবছর নিট মুনাফা করেছে ১০৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ডেসকোর নিট মুনাফা ৭৩ কোটি টাকা। পল্লী বিদ্যুতের ৮০টি সমিতির নিট মুনাফা ২০ কোটি টাকা, ওজোপাডিকোর ২৪ কোটি টাকা। নেসকোর লাভ প্রায় ১৮ কোটি টাকা। পিজিসিবি গত অর্থবছরে লাভ করেছে ৩৩৭ কোটি টাকা।
অন্যদিকে, তিতাস নিট মুনাফা করেছে ৩৪৬ কোটি টাকা। কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডার ২২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। জালালাবাদ ২০২০-২১ অর্থবছরে লাভ করেছে ২১৮ কোটি টাকা। বাখরাবাদ গ্যাস কোম্পানির নিট মুনাফা ১২৬ কোটি টাকা।
কর্ণফুলী গ্যাসের লাভ ৩৫১ কোটি টাকা। পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস ছয় কোটি টাকা নিট লাভ করেছে গত অর্থবছরে। সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানির মুনাফা ৫৯ কোটি টাকা। জিটিসিএল মুনাফা করেছে ২৩৭ কোটি টাকা এবং ট্যাক্স, ভ্যাট ও ফি বাবদ সরকারি কোষাগারে দিয়েছে ৭৫৩ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
খাত-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনা দূর না করে, বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা না নিয়ে দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ মূলত সরকারের ব্যর্থতার দায় জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার নামান্তর।
তিন মাস আগে ডিজেলের দাম বেড়েছে। এখন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দেবে। পরিবহন, কৃষি, শিল্প থেকে শুরু করে ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি খাতের ব্যয় বাড়বে।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে যেভাবে জ্বালানির দাম বাড়ছে, তাতে ঘাটতি সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তারপরও দাম বাড়বে কিনা, তা বিইআরসি শুনানির মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে ঘোষণা করবে।
বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, বিশ্ববাজারে যে পরিস্থিতি, তাতে সরকার হয়তো দাম বাড়াবেই। তবে জনজীবন ও দেশের শিল্প অর্থনীতির দিকে লক্ষ্য রেখে এই খাতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা উচিত।
বিইআরসি চেয়ারম্যান আবদুল জলিল বলেন, বিতরণ কোম্পানিগুলো কোনো প্রস্তাব দিলে তা যাচাই-বাছাই করে শুনানির আয়োজন করা হবে। গ্যাসের তিনটি বিতরণ কোম্পানির প্রস্তাব পাওয়া গেছে। তাদের প্রস্তাবে ঘাটতি রয়েছে। বিধি অনুসরণ করে আবার প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৩৫
আপনার মতামত জানানঃ