শ্রীলঙ্কার মুসলিম সম্প্রদায় এখন বর্ণবৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার। তবে দীর্ঘ তিন দশক ধরে শ্রীলঙ্কায় হয়ে যাওয়া গৃহযুদ্ধে সরকারের মিত্র ছিল দেশটির সংখ্যালঘু মুসলিমরা। তামিলদের সঙ্গে যুদ্ধ শেষে সে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির মুসলিম নেতারা বলেছেন, সিংহলিদের সঙ্গে মুসলিমদের সম্পর্ক বেশ ভালোই ছিল। ২০০৯ সালে তামিলরা পরাজিত হলে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে।
যেভাবে শুরু এই বৈষম্যমূলক নিপীড়নের
বিভিন্ন ডানপন্থি সিংহলিজ সংগঠন প্রায়ই মুসলিমদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লক্ষ্য করে হামলা চালাতে থাকে। ইস্টার সানডের বোমা হামলার ঘটনার আগে থেকেই এমনটি চলে আসছে।
ইস্টার সানডের দিনে বোমা হামলাটি ছিল মুসলিমদের জন্য একটি চরম মুহূর্ত। বোমা হামলার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মুসলিমদের সম্পদ ও মসজিদে সিংহলিদের হামলা শুরু হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতেও মুসলিমদের ব্যাপারে ঘৃণা ছড়ানো শুরু হয়। কট্টরপন্থি সিংহলিরা প্রচার করতে থাকে যাতে সবাই মুসলিম মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বয়কট করে।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকশে। তিনি ২০১৯ সালের নভেম্বরে ক্ষমতায় আসেন। তার ক্ষমতায় আসার পেছনে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের নিরঙ্কুশ সমর্থন ছিল।
শ্রীলঙ্কা মুসলিম কাউন্সিলের সদস্য হিলমি হামিদের মতে, মুসলিম বিদ্বেষ হলো দেশটির রাজনীতিতে একটা ট্রাম্প কার্ড, তারা প্রচার করে দেশটি ইসলামি মৌলবাদের হুমকিতে রয়েছে।
করোনায় বেড়েছে ধর্মীয় বৈষম্য
এমনকি মহামারির সময় দেশটির সরকার সংখ্যালঘু মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়াদের লাশ স্বজনদের কাছে দাফনের জন্য হস্তান্তর করেনি।
কিছু দেহ জোরপূর্বক পোড়ানো হয়। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হওয়া ব্যক্তিদের নিরাপদে দাফনের ব্যবস্থা করা সম্ভব।
ইসলামের দৃষ্টিতে মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা নিষিদ্ধ। কর্তৃপক্ষ সে সময় প্রচার করে, মৃতদেহ দাফন করলে ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত হতে পারে।
পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘু ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবির মুখে পূর্ব শ্রীলঙ্কার একটি নির্ধারিত স্থানে কোভিডে মৃত্যু হওয়া মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের দাফন করার অনুমতি দেয় দেশটির সরকার।
এ ছাড়া গত বছর শ্রীলঙ্কা সরকার বোরকা নিষিদ্ধের প্রস্তাব সামনে নিয়ে আসে। তাদের দাবি, মুখ ঢাকা যেকোনো পোশাক জাতীয় নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ করতে পারে। একজন বোরকাকে ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেন।
মানবাধিকার আইনজীবী বাভানি ফনসেকা বলেন, গৃহযুদ্ধ শেষে মুসলিমরা হয়ে গেছে নতুন শত্রু। আমরা ইতিমধ্যেই মুসলিম সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে বেশ কিছু হামলার ঘটনা ঘটতে দেখেছি।
কী বলছে দেশটির সরকার?
তবে দেশটির সরকার মুসলিমদের ভিন্নভাবে দেখার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। শ্রীলঙ্কা সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মহান সামারানায়েক বলেন, কোনো সম্প্রদায়কে ভিন্ন চোখে দেখার মতো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা পদ্ধতিগত নীতি দেশটির নেই।
তিনি বলেন, তবে আমি স্বীকার করছি, কিছু সমস্যা হয়তো সব সম্প্রদায়ের মধ্যেই আছে, এমনকি সিংহলিদের মাঝেও।
তবে মাদ্রাসা বন্ধের প্রস্তাবের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘ইস্টার সানডে বোমা হামলার পর তদন্তে বেরিয়ে আসা প্রতিবেদনের সাপেক্ষেই এই প্রস্তাব করা হয়েছে। তদন্তে দেখা গেছে, কিছু কিছু মাদ্রাসা মুসলিম তরুণদের মৌলবাদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।’
কী ভাবছেন দেশটির মুসলিম জনগোষ্ঠী?
এ ছাড়া সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত সরাসরি সংখ্যালঘুদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেছে বলে মনে করছে দেশটির সংখ্যালঘু বিভিন্ন সম্প্রদায়।
গত নভেম্বরে রাজাপাকশে দেশটির আইনে কিছু পরিবর্তন আনার জন্যে ‘টাস্কফোর্স ফর ওয়ান কান্ট্রি, ওয়ান ল’ গঠন করেছেন। এর ফলে বিবাহ ও সম্পত্তি সংক্রান্ত সংখ্যালঘুদের বিশেষ আইন বলে কিছু থাকবে না।
বিতর্কিত বৌদ্ধ ভিক্ষু জনানরাসা যিনি মুসলিমবিরোধী হিসেবে পরিচিত। তিনি বলেন, ধর্মীয় সমস্যা সৃষ্টি করার খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ৫০০ টির ওপর সংগঠন আছে। এ ছাড়া কিছু ইসলামিক সংগঠন ওহাবিজম ও সালাফিজম প্রচার করছে।
এদিকে রিজার্ভে বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের কারণে শ্রীলঙ্কা ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবিলা করছে। মুসলিম কমিউনিটির নেতাদের ধারণা পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ঘোরাতে মুসলিমবিদ্বেষ আরও বাড়তে পারে।
হেজাজ হিজবুল্লাহ নামের একজন মুসলিম মানবাধিকার আইনজীবী প্রায় ২০ মাস যাবৎ সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত থাকার অভিযোগে কারাগারে আটক রয়েছেন।
প্রসিকিউটর তার বিরুদ্ধে সমাজে অস্থিরতা ও ঘৃণাসূচক মতাদর্শ প্রচারের অভিযোগ এনেছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, তিনি মুসলিম তরুণদের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ওপর খেপিয়ে তুলতেন।
হেজাজের স্ত্রী মারাম খলিফা তার স্বামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করে জানান, তার স্বামী একজন স্পষ্টভাষী মানুষ। তিনি সব সময় মুসলিম ও সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করতেন।
তিনি আরও বলেন, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ কেবলই একটি সতর্কবার্তা তাদের প্রতি, যারা বর্ণবিদ্বেষ ও বৈষম্য নিয়ে কথা বলে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪০০
আপনার মতামত জানানঃ