পাকিস্তানে গুম ও জোরপূর্বক অপহরণের বিষয়টি অনেক পুরনো হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তাদের স্বার্থ রক্ষার্থেই এই নির্মম গুম-অপহরণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণাধীন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
ক্ষমতাসীনদের তালিকা ধরে বেছে বেছে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী, মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক গুম অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে সংস্থাটি। এ কাজ করে আসছে দেশটির সেনাবাহিনীসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
তবে এসব গুম ও অপহরণ নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগের উপহাস করেছে পাকিস্তান। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে দেশটিতে গুম-অপহরণ হচ্ছেই, যা ইসলামাবাদের মানবাধিকার পরিস্থিতির কলঙ্ক। কানাডাভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক ‘ইন্টান্যাশনাল ফোরাম অন রাইটস অ্যান্ড সিকিউরিটি’ (আইএফএফআরএস) এ কথা জানিয়েছে। খবর এনএনআই
প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, গণমাধ্যমের সমীক্ষা, মানবাধিকার কর্মীদের প্রতিবাদ ও বিচারবিভাগীয় হস্তক্ষেপ কোনোকিছুই সরকারের বিবেককে নাড়া দিতে পারছে না। গত সেপ্টেম্বরে গুম নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের একটি ওয়ার্কিং গ্রুপের (ডব্লিউজিইআইডি) ১২৫তম সেশনে এ ব্যাপারে উদ্বেগ জানানো হয়।
ডব্লিউজিইআইডি এ ব্যাপারে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে। সেখানে পাকিস্তানে গুম-অপহরণ নিয়ে কিছু ক্ষেত্রে দেশটির তৎপরতা দেখা যায়। তবে প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের ব্যাপারে ‘পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় অনীহা’ রয়েছেই, একই সঙ্গে তারা জাতিসংঘের সংস্থাটিকে অসম্মান জানিয়েছে।
সাত থেকে আট বছর আগের গুমের ঘটনাগুলোর ব্যাপারে পাকিস্তান বলছে, বিষয়গুলো নিয়ে এখনো তদন্ত চলছে। আইএফএফআরএস জানিয়েছে, গুমের ঘটনার ক্ষেত্রে অপরাধীদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। অপহরণের কেউ ফেরত আসলে সে ক্ষেত্রে আর কোনো তদন্ত করা হয়নি। গুমের এসব ঘটনা আন্তর্জাতিক সংস্থার নজর এড়াতে পাকিস্তান অভিযোগগুলো কমিয়ে ফেলেছে।
গুম ও অপহরণ নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগের উপহাস করেছে পাকিস্তান। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে দেশটিতে গুম-অপহরণ হচ্ছেই, যা ইসলামাবাদের মানবাধিকার পরিস্থিতির কলঙ্ক।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পাকিস্তানের কাছে আবেদন জানিয়েছে। গত নভেম্বরে সংস্থাটি অপহরণের শিকার পরিবারগুলো নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছিল। এর নাম দেওয়া হয় ‘লিভিং গোস্ট’। এতে ভুক্তভোগীদের পরিবারের ১০ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে অপহরণের পর তাদের জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের পর পাকিস্তানে গুমের ঘটনা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। বৃদ্ধি পায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। দেশটির বহু মানুষ শিকার হয় আত্মঘাতী বোমা হামলার।
মোশাররফের আমলেই শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তানের সম্মিলিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’। বহু লোককে সন্ত্রাসী সন্দেহে আটক করে নিয়ে যায় সরকারি বাহিনীগুলো। আটককৃতদের অনেককেই তুলে দেয়া হয় মার্কিন কর্তৃপক্ষের হাতে।
বন্দি করে রাখা হয় কুখ্যাত গুয়ানতানামো কারাগারে। গুমের বিরুদ্ধে কাজ করে এমন মানবাধিকার সংস্থা ডিফেন্স অব হিউম্যান রাইটস পাকিস্তানের চেয়ারম্যান ও খ্যাতনামা মানবাধিকার কর্মী আমিনা মাসুদ জাঞ্জুয়া বলেন, গত দুই দশকে পাকিস্তানে ৫ হাজারের বেশি গুমের ঘটনা ঘটেছে।
অ্যামনেস্টির মতে, ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত কমিশনের কাছে ৩ হাজার গুমের মামলা এসেছে। গুমের ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই সিন্ধু ও বেলুচিস্তানের।
তবে দেশটির বিচারবিভাগ বলছে, এই সংখ্যা অতিরঞ্জিত। যারা এ ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সরকারের সেই বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে লিখিত কোনো অভিযোগ বা কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না।
ডন বলছে, কেবল ২০১৬ সালের প্রথম ৭ মাসেই ৫১০টি গুমের রিপোর্ট করেছে পত্রিকাটি। গুমের ঘটনা তদন্ত করতে দেশটিতে কমিশন অব ইনকয়ারি অন এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়অরান্স নামে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান পলিটিক্সের অধ্যাপক আকিল শাহ বলেন, রাজনীতিবিরোধী নেতাদের গুম-অপহরণ সংস্কৃতি এ অঞ্চলের বহুল প্রচলিত ‘পুরাতন ঐতিহ্য। সম্প্রতি বছরগুলোতে এ অপচর্চা আরও বেড়েছে। আর এ জন্য দায়ী সরকার ও তার আজ্ঞাবহ রাষ্ট্রীয় বাহিনী। সরকারি স্বার্থবিরোধী সামাজিক মাধ্যম ও রাজনীতিক, অধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের ওপর সাঁড়াশি অভিযানের মাত্রা বৃদ্ধি করেছে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৮
আপনার মতামত জানানঃ