যখন যে পক্ষ শক্তি দেখাতে পারে, সরকার সে পক্ষকে খুশি করার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
শনিবার সকাল সোয়া ১১টার দিকে রাজধানীর সেগুনবাগিচার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সামনে আয়োজিত এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করা হয়।
সব পথের গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ পাস ও সরকার নির্ধারিত ভাড়া কার্যকরের দাবিতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, যখন যে পক্ষ শক্তি দেখাতে পারে, সে পক্ষকে খুশি করার চেষ্টা করে সরকার। তবে পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা যেহেতু সংগঠিত এবং প্রভাবশালী, দিন শেষে সরকারি সিদ্ধান্ত তাদের পক্ষেই যায়।
পরিবহন খাতে দীর্ঘদিন ধরে সুশাসন অনুপস্থিত আছে উল্লেখ করে মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ৩০ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এর সিংহভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। অন্যদিকে শাহজাহান খানের নেতৃত্বে ১০১ দফা সুপারিশ প্রণয়নের পর তা এখন ডিপ ফ্রিজে আটকা পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এই পরিবহন খাতে সুশাসন অনুপস্থিত। এ কারণে যে যার মতো করে চলছে।
সমিতির মহাসচিব বলেন, নিরাপদ সড়কের সব উদ্যোগ আটকে যাচ্ছে প্রভাবশালী পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের চাপে। সাড়ে তিন বছর আগে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর সরকার অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, জানিয়েছিল কিছু উদ্যোগের কথাও। কিন্তু শিক্ষার্থীরা আন্দোলন ছেড়ে শ্রেণিকক্ষে ফেরার পর বিভিন্ন দাবিতে পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা রাস্তায় নামেন। এরপর সরকারের প্রতিশ্রুতি ও উদ্যোগও সব আটকে যায়। ফলে ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা গিয়েছিল, চলতি বছরের প্রথম আট মাসেই তা ছাড়িয়ে গেছে।
নিরাপদ সড়কের সব উদ্যোগ আটকে যাচ্ছে প্রভাবশালী পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের চাপে।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিন আন্দোলনের পর প্রথমে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী সারা দেশের বিআরটিসি বাসে ও পরে বাস মালিক সমিতি ঢাকা মহানগরীতে ১ ডিসেম্বর থেকে শিক্ষার্থীদের হাফ পাসের সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিলেও এখনো তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। রাজধানীর অনেক বাসে শিক্ষার্থীদের উঠানো হচ্ছে না। অনেক বাসে অর্ধেক ভাড়া নেয় না। শিক্ষার্থীরা হাফ ভাড়া দিলে তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থীকে বাস থেকে নামার সময় ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিচ্ছে। এতে করে যেকোনো সময় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে উঠার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি শিক্ষার্থীসহ সকল যাত্রীদের সম্মানের সহিত গণপরিবহনে যাতায়াতের সুযোগ নিশ্চিত করা দাবি জানান।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী আরো বলেন, ‘পরিবহন সেক্টরে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন সড়কে এহেন অব্যবস্থাপনার জন্য তারাই দায়ী। এই সেক্টরের ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য বর্তমানে নেতৃত্বদানকারী পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতৃত্বের পরিবর্তন জরুরি। এই নেতারা সরকারের সঙ্গে থেকে পরিবহন ধর্মঘটের নামে জনগণকে জিম্মি করে সরকারের কাছ থেকে নানাভাবে ফায়দা লুটছে। তারা রাজধানীর বাসে বারবার ঘোষণা দিয়েও সিটিং সার্ভিসের ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধ না করে এসব গাড়িতে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার ৩ থেকে ৪ গুণ বাড়তি ভাড়া আদায় করে নগর জীবন বিষিয়ে তুলেছে।’ তিনি দেশের সকলপথে সকল শ্রেণির গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধ করে সরকার নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর করার দাবি জানান।
যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, সড়কে সবাই ইচ্ছেমতো প্রভাব বিস্তার করে আইন ভাঙছেন। চাঁদাবাজি, হয়রানি ও নৈরাজ্য এখন চরম আকার ধারণ করেছে। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে এসেছিল। তখন সবাই বলেছিলেন শিক্ষার্থীরা তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। কিন্তু দেখা গেল, কিছুদিন পর সবই আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। রাস্তায় মৃত্যু বন্ধ না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা আবার রাস্তায় ফিরে এল।
সংবাদ সম্মেলনে যাত্রী কল্যাণ সমিতির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শরিফুজ্জামান বলেন, নিরাপদ সড়ক নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরকার মিথ্যাচার করছে। শিক্ষার্থীদের এখন যা দাবি ২০১৮ সালেও একই দাবি ছিল। শিক্ষার্থীদের দাবি সরকারের কাছে, কিন্তু সরকার শিক্ষার্থীদের কথা শুনছে না, কৌশল করে মালিক সমিতির কথা শুনছে। সড়কে এ নৈরাজ্যের দায় সরকারের। কারণ, সরকারই এমন ব্যবস্থা তৈরি করে দিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা, যাত্রী কল্যাণ সমিতি সহসভাপতি তাওহিদুল হক, সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম প্রমুখ।
যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, শিক্ষার্থীদের এবারের আন্দোলন শুধু হাফ ভাড়ার জন্য নয়, সড়কে পুরো অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে। রাষ্ট্র এ বিশৃঙ্খলা বন্ধ না করলে, এর সমাধান পাওয়া কঠিন। দিনের পর দিন এভাবে চলতে পারে না।
সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি ২০ দফা সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো—একজন শিক্ষার্থীকে তার ছাত্রজীবনে সার্বক্ষণিক এবং যেকোনো দিন, যেকোনো সময় আইডি কার্ড প্রদর্শন সাপেক্ষে সারা দেশের সড়ক, রেল, নৌপথে সব শ্রেণির গণপরিবহনে হাফ পাস সুবিধা নিয়ে অর্ধেক ভাড়ায় যাতায়াতের সুযোগ দিতে হবে, শিক্ষার্থীদের পরিবহনে নিতে অস্বীকৃতি জানালে, হাফ ভাড়া না নিলে, সংশ্লিষ্ট পরিবহনের চালক, সহকারী, কাউন্টারম্যান, টিকিট বিক্রয়কারীর কী শাস্তি হবে, তা স্পষ্ট করে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা জারি করতে হবে, সব শ্রেণির গণপরিবহনে দৈনিক চুক্তিতে ইজারা দেওয়া বন্ধ করতে হবে, সব শ্রেণির গণপরিবহনে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা স্পষ্ট আকারে দৃশ্যমান স্থানে টানাতে হবে, সিটিং সার্ভিস নামের ওয়েবিল প্রথা বাতিল করতে হবে, ভাড়া আদায় করলে অভিযুক্ত বাসের চালক-সরকারি পাশাপাশি মালিক-চেয়ারম্যান-এমডিকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে, বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া পাঁচ টাকা করতে হবে, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০৬
আপনার মতামত জানানঃ