আফগানিস্তানে দীর্ঘদিন ধরে চলা সংঘাত-সংঘর্ষ-সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে দেশটির শিশুদের ওপর। সম্প্রতি প্রকাশিত ইউনিসেফ-এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, আফগানিস্তানে ৪০ লাখেরও বেশি শিশু স্কুলের বাইরে রয়েছে। যার মধ্যে মেয়েরা অর্ধেকেরও বেশি। তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। খবর দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার।
সংস্থাটি বলছে, তারা তাদের সহায়তার পরিমাণ বাড়িয়েছে। গত তিন মাসে ১৪২,৭০০ আফগান শিশুদের শিক্ষার জন্য সহায়তা দিয়েছে।
ইউনিসেফ একটি টুইটে বলেছে, পুরো আফগানিস্তানে ১৪২,৭০০ শিশুর শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে ৫৩৫০টি সম্প্রদায় ভিত্তিক ক্লাসের ব্যবস্থা করেছে তারা। এখানে আরও কিছু করা দরকার।
টোলো নিউজের একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, তুরস্ক ভিত্তিক একটি এনজিও আফগানিস্তানের যেসব শিশুরা তুর্কি স্কুলে পড়তে আগ্রহী তাদের জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষার আয়োজন করেছে। প্রতি ৩,৫০০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১০০০ জন শিক্ষার্থী এই স্কুলে পড়ার সুযোগ পাবে।
মেরিফ ফাউন্ডেশনের প্রধান সালেহ মোহাম্মদ সাগির বলেছেন, আফগানিস্তানে প্রশাসনিক এবং শিক্ষা বিভাগে এক হাজারেরও বেশি তুর্কি কর্মচারী রয়েছে। যারা আফগানিস্তানে সেবা প্রদানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
কাবুল শিক্ষা বিভাগের প্রধান ইহসানুল্লাহ খিতাব বলেছেন, ‘আমরা আমাদের বন্ধু দেশগুলোর কাছ থেকে সহযোগিতা কামনা করছি। বিশেষ করে তুরস্ককে। আমরা শিক্ষার সুযোগ সুবিধা দেওয়ার জন্য তুরস্ককে ধন্যবাদ জানাই।’
১৫ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা দখলের পর তালিবান আগের কঠোর মনোভাব থেকে সরিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু নারীদের স্কুলে ফেরা এবং কর্মক্ষেত্রে ফেরার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞাসহ নারীদের প্রতি তালিবানের বিরূপ মনোভাব অব্যাহত রয়েছে।
সম্প্রতি আফগানিস্তানের মাধ্যমিক পর্যায়ে ছেলে শিক্ষার্থী এবং পুরুষ শিক্ষকদের ফেরার অনুমতি দেয় তালিবান সরকার। কিন্তু মেয়েদের স্কুলে ফেরার অনুমতি দেয়নি। তারা কবে স্কুলে ফিরতে পারবে বিষয়টি স্পষ্টও করেনি। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে আফগান তালিবান সরকার। এ ছাড়া নারীদের নতুন সরকারেও রাখা হয়নি।
এর আগে ১৯৯৬-২০০১ সালে তালিবান সরকারের অধীনে নারীদের অধিকার সম্পূর্ণ হরণ করা হয়। কেনো মেয়ে স্কুলে যেতে পারতো না, বাইরে কাজ করতে পারতো না। সবাইকে বোরকা ও হিজাব পরিধান করতে হতো এবং বের হতে হলে পরিবারের একজন পুরুষ সদস্যকে বাধ্যতামূলত সঙ্গে রাখা লাগতো। এছাড়া তাদের জোর করে বাল্যবিবাহ দিতো তালিবান শাসকগোষ্ঠী।
তবে এবার ক্ষমতায় এসে তালিবান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ইসলামি আইনের অধীনে তারা এবার নারীদের অধিকার নিশ্চিত করবে। যদিও সেটিতে এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না আফগান নারীরা।
এর মাঝেই গত মাসেই তালিবান নির্দেশ দিয়েছে, নারীরা যেন আপাতত ঘরে থাকে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, নারীদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হয়, তা অনেক তালিবান সদস্য এখনো জানে না। তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরই নারীরা বাইরে কাজের সুযোগ পাবে। তবে এটাকে তালিবানের এক প্রকার কৌশল বলে মনে করছেন অনেকেই।
আফগানিস্তানে হাহাকার চলছে। খাবারের জন্য হন্যে হয়ে ছুটছে মানুষ। তার ওপর আসছে তীব্র শীত, বাড়ছে শঙ্কা। কারণ, ইতিমধ্যে অনেক এলাকা খরার কবলে পড়েছে। ফলে ফসল উৎপাদনে ধস নামার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছাড়া তালিবান ক্ষমতায় আসার পর দেশটিতে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সামনের দিনগুলোতে ভয়ংকর বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে আফগানেরা। আর এসবের চোট সবচেয়ে বেশি পড়তে যাচ্ছে শিশুদের ওপর। চলতি বছরের শেষ নাগাদ আফগানিস্তানে প্রায় ৩২ লাখ শিশু চরম অপুষ্টির শিকার হতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তাপমাত্রা কমতে শুরু করায় এদের মধ্যে অন্তত দশ লাখ শিশু মারা যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ২ কোটি ২০ লাখের বেশি আফগানকে সাহায্য করতে হিমশিম খাচ্ছে ডব্লিউএফপি। এরপর যদি সামনের দিনগুলোতে আবহাওয়ার অবস্থা খারাপ হয়, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। শীতের সময় আবহাওয়া খারাপ হওয়ার যে আভাস বিশেষজ্ঞরা দিয়েছেন, সেটা যদি হয় তাহলে বিপুল সংখ্যা মানুষ মারাত্মক ক্ষুধায় ভুগবে এবং সুদূরপ্রসারী দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে।
খাদ্য সংকট কতটা চরমে পৌঁছালে একজন বাবা তার কন্যাসন্তানকে বিক্রি করতে বাধ্য হন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে একজন বাবার এছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। দেশে ভয়াবহ আর্থিক সংকট তৈরি হওয়ায় আফগানিস্তানের অনেক নাগরিককেই এখন এমন মর্মান্তিক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
মানবাধিকারকর্মী বলেন, আফগানিস্তানে দিনের পর দিন কন্যা শিশুসন্তান বিক্রির ঘটনা বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে বলেন, খাদ্য ও কাজের অভাব এবং বিভিন্ন সংকটে থাকা পরিবারগুলো এমন সিদ্ধান্তকেই সঠিক বলে মনে করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন সন্ত্রাসী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকা তালিবান ভেবেছিল সরকার চালানো বোধহয় খুব সহজ। মানুষ খুন করা আর দেশ চালানো যে এক নয়, সেটা তারা বোঝেনি। দুর্নীতি আর বেহাল অর্থনীতি শুরুতেই কাঁধে চেপে বসেছে তালিবান শাসকদের। অর্থনীতি তো দূরের কথা, শান্তি ফেরাতেও হিমশিম খাচ্ছে দখলদার সরকার। ক্ষমতায় আসার আগে আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তালিবান। বোঝাতে চেয়েছিল, গত দুই দশকে তাদের মানসিকতার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তারা যে বিন্দুমাত্র নিজেদের মানসিকতা বদলায়নি ক্ষমতায় এসেই চরম বর্বরতার পরিচয় দিয়ে তারা সেটা আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক সাহায্যের বহর কমছে।
মনে করা হয়, তালিবানকে সাহায্য করা মানেই জঙ্গিবাদ ও মাদক চোরাকারবারীদের মদদ। আত্মঘাতী বোমারুদের যেমন তারা প্রকাশ্যেই উৎসাহিত করছে, তেমনি ক্ষমতায় আসার পর ফের মাদক ব্যবসার কথাও বলছেন তালিবান মন্ত্রীরা। নারী ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বহরও কমেনি। তাই বেশিরভাগ দেশই তালিবানের ওপর ক্ষুব্ধ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২১
আপনার মতামত জানানঃ