রাজধানী ঢাকার বায়ু দূষণের মাত্রা বিপজ্জনক পর্যায়ে অবস্থান করছে। বিশ্বে শীর্ষ দূষিত কয়েকটি শহরের অন্যতম ঢাকার মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর সর্বাধিক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মানুষের গড় আয়ু কমছে দীর্ঘমেয়াদী বায়ু দূষণের কারণে।
বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস এবং ঢাকায় কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস। এমনটা দাবি করেছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।
শনিবার (২৭ নভেম্বর) ‘ধূলা দূষণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও মৃত্যু—ধূলা দূষণ রোধে চাই কার্যকর পদক্ষেপ’ শীর্ষক মানববন্ধনে বক্তারা এ দাবি করেন। জাতীয় জাদুঘরের সামনে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) সহ সমমনা ৯টি সংগঠন এ মানববন্ধনের আয়োজন করে।
মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান। সংগঠনটির সম্পাদক এম এ ওয়াহেদের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি নাজিমউদ্দীন, বীর মুক্তিযোদ্ধা কে এম সিদ্দিক আলী, আইন বিষয়ক সম্পাদক মো. ওমর ফারুক প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, লাইফ ইনডেক্সের গবেষণা মতে, ১৯৯৮ সালে বায়ুদূষণের কারণে গড় আয়ু কমেছিল প্রায় দুই বছর আট মাস, ২০১৯ সালে সেটি পাঁচ বছর চার মাসে দাঁড়িয়েছে। গবেষণা বলছে, সারা দেশের ৬৪টি জেলার প্রত্যেকটিতেই বায়ুদূষণের হার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী অন্তত তিনগুণ বেশি। দূষিত বাতাসে কঠিন ও তরল পদার্থ উড়ে বেড়ায়, যার মধ্যে রয়েছে কাচ, ধোঁয়া বা ধূলা—যেগুলোকে ‘বস্তুকণা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, রাজধানী ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় সবোর্চ্চ দূষিত বায়ুর শহর। ধূলার কারণে এই দূষণের মাত্রা এখন আরও ভয়াবহ। ঢাকা শহরের প্রায় দেড় কোটি মানুষ আসলে এক অবিশ্বাস্য বিষাক্ত গ্যাসের মধ্যে বাস করছে। নতুন নতুন অবকাঠামোর নামে প্রতিনিয়ত খোঁড়াখুঁড়ির হচ্ছে নগরের বিভিন্ন স্থানে। ফলে ধূলা হয়ে উঠেছে নিত্যসঙ্গী। শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা মহানগরীতে ধূলা দূষণের প্রকোপ অত্যন্ত বেড়ে যায়। আমাদের দেশের বিশেষ করে ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ ইটভাটা, কলকারখানা, নির্মাণকাজ এবং যানবাহনের ধোঁয়া। এ অবস্থায় বায়ুদূষণে ঢাকায় গড় আয়ু কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, শীর্ষ দূষিত নগরীর মধ্যে ঢাকা মহানগরী অন্যতম। বায়ুদূষণের প্রধান উৎসগুলো প্রায় সকলেরই কমবেশী জানা। যন্ত্রচালিত যান থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া, ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া, বিভিন্ন শিল্প কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া, প্লাস্টিক ও ইলেকট্রনিক্স বর্জ্য প্রসেসিং/পোড়ানো থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া- এগুলোর মধ্যে অন্যতম। বর্ষাকালে বৃষ্টির ফলে বায়ুদূষণ কমে যায়, বাতাস চলাচলে দূষিত বায়ু দূরে চলে যায়। ফলে সে সময় বায়ুদূষণ কিছুটা কম থাকে। শীতকালে ইটের ভাটার কার্যক্রমে দূষণ বৃদ্ধি পায়। নির্মাণকাজ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ সময় আবহাওয়া শুষ্ক থাকার কারণে ধূলা বাতাসে অনেকক্ষণ উড়ে বেড়ায়। ফলে ধূলা দূষণও বৃদ্ধি পায়।
বক্তারা আরও বলেন, অন্যান্য উৎস থেকে ধোঁয়া ও ধূলা একত্র হয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি করে এবং এই দূষিত বায়ু দীর্ঘক্ষণ একই জায়গায় অবস্থান করে। ফলে অন্যান্য উৎসের সঙ্গে ধূলা দূষণ একত্রিত হয়ে বাতাস দূষণের মাত্রা অত্যাধিক বৃদ্ধি পায়। সরকার ধূলা দূষণ রোধে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তা বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত নয়। সম্প্রতি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বায়ুদূষণের কারণে এত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে সেদেশের সরকার স্কুল কলেজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। ঢাকার পরিস্থিতি সেদিকে ধাবিত হচ্ছে বলে বক্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এ অবস্থায় বায়ুদূষণের হাত থেকে বাঁচার জন্য সরকারকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানান তারা।
মানববন্ধনে বক্তারা আরও বলেন, অপরিকল্পিতভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ এবং রাস্তাঘাট উন্নয়ন, মেরামত ও সংস্কার কার্যক্রমের আওতায় রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও মাটি, বালি, ইটসহ নির্মাণসামগ্রী আচ্ছাদনহীন ট্রাকে করে শহরে পরিবহন করা, ড্রেন পরিষ্কার করে ময়লা রাস্তার পাশে স্তুপ করে রাখা, দোকান পাট ও গৃহস্থালির আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলে রাখা, মেরামতহীন ভাঙাচোরা রাস্তায় যানবাহন চলাচল, পাকা ভবন নির্মাণের সময় মাটি, বালু, ইটসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী রাস্তা-ফুটপাতে ফেলে রাখা, পুরাতন ভবন ভাঙা, মেশিনে ইট ভাঙা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ধোঁয়া ইত্যাদি ধূলা দূষণের অন্যতম উৎস। এসব উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ ধূলা বাতাসে মিশে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব ফেলছে।
বায়ুদূষণের ফলে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের হৃৎপিণ্ড, বেড়ে যাচ্ছে উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগ। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কিডনির নানা জটিল অসুখও।
ঢাকার রাস্তায় চলাচলকারী অতিরিক্ত যানবাহন যানজট সৃষ্টির পাশাপাশি রাজধানীর বায়ুদূষণেও অন্যতম ভূমিকা পালন করছে বলেও উল্লেখ করেন বক্তারা। ঢাকা শহরে প্রতিদিন গড়ে প্রায় তিন লাখ যান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করে। নগরীতে চলাচলকারী গণপরিবহনের প্রায় সবগুলো বাস-মিনিবাস, প্রাইভেটকার, সিএনজি অটোরিকশা, টেম্পোসহ গাড়িগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে। ফিটনেসবিহীন এসব গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ুদূষণের জন্য দায়ী।
এদিকে সাম্প্রতিক একটি গবেষণা জানিয়েছে, বায়ুদূষণের ফলে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের হৃৎপিণ্ড, বেড়ে যাচ্ছে উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগ। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কিডনির নানা জটিল অসুখও।
গবেষকরা দেখেছেন, দীর্ঘদিন ধরে কিডনির অসুখে ভুগছেন এমন প্রাপ্তবয়স্কদের উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে সঙ্গে গ্যালেক্টিন প্রোটিনের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে বায়ুদূষণের মাত্রাবৃদ্ধির কারণে। এই গ্যালেক্টিন প্রোটিনের পরিমাণ দেহে বাড়লেই হৃৎপিণ্ডে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। আর সেই ক্ষত কিছুতেই সারিয়ে তোলা সম্ভব হয় না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় যার নাম ‘মায়োকার্ডিয়াল ফাইব্রোসিস’।
মূল গবেষক যুক্তরাষ্ট্রের কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক হাফসা তারিক বলেছেন, ‘যখনই আমাদের হৃদযন্ত্রে ফাইব্রোব্লাস্ট নামে একটি বিশেষ ধরনের কোষ কোলাজেন তৈরি করতে শুরু করে, তখনই হয় মায়োকার্ডিয়াল ফাইব্রোসিস। তার ফলে নানা ধরনের হৃদরোগ হয়। ডেকে আনে মৃত্যু।’
গবেষকরা দেখেছেন, বাতাসে বিশেষ ধরনের দূষণ কণার (পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫) পরিমাণ বাড়লেই এটা হচ্ছে। সেই কণা বাতাসে কম থাকলে বা একেবারে না থাকলে কিডনি, হৃৎপিণ্ডের ততটা ক্ষতি হচ্ছে না। খুব ক্ষতি হচ্ছে কিডনিরও। গবেষকরা দুবছর ধরে প্রায় দেড় হাজার রোগীর উপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালিয়ে এই ঘটনা ঘটতে দেখেছেন।
নগর সভ্যতার ডামাডোলে গোটা বিশ্ব এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যেখানে প্রাণ ধারণের জন্য ন্যূনতম বিশুদ্ধ আলো, বাতাস ও পানির মতো প্রকৃতির অফুরান দানগুলো অবশিষ্ট থাকার সুযোগ নেই। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে নানা বিরূপ প্রভাবসহ মানবসৃষ্ট পরিবেশ দূষণের কবলে পড়ে ক্রমেই হুমকির মুখে এগিয়ে চলছে জনজীবন। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দ্রুত শিল্পায়নের এই অশুভ প্রতিযোগিতার করাল গ্রাসে পড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে, লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে দূষণ। প্রতি বছর বিশ্বে বায়ুদূষণের কারণে অন্তত ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়৷
বায়ুদূষণ সব দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। তবে এটি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় চরম ঝুঁকি তৈরি করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য দেয়া হয়েছে৷
ডব্লিউএইচও’র মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে তৈরি হচ্ছে মারত্মক বায়ুদূষণ। এর ফলে ফুসফুস হৃদযন্ত্র ও শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বস্তুকণা, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডসহ অন্যান্য দূষণ তৈরিকারী উপাদানের উপস্থিতি কমাতে হবে।
সংস্থাটির মতে, বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি বায়ুদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম পরিবেশগত হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে ডব্লিউএইচওর প্রধান তেদ্রোস আধানম গেব্রেয়াসুস বলেন, ‘বায়ুদূষণ সব দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। তবে এটি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় চরম ঝুঁকি তৈরি করেছে।’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি নগরায়ন ও শিল্পায়নের হার বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। অনুষঙ্গ হিসেবে পরিবেশ দূষণ বিশেষ করে বায়ুদূষণের মাত্রাও বেড়েছে বহুগুণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, পৃথিবীর শতকরা প্রায় ৯১ ভাগ মানুষ সংস্থাটির নির্ধারিত মান মাত্রার নির্মল বায়ু সেবন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এছাড়া প্রতি বছর বায়ুদূষণের জন্য বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বায়ুদূষণ প্রকট আকার ধারণ করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরবাসীর কাছে যানজটের পাশাপাশি আরেক যন্ত্রণার নাম বায়ুদূষণ। মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কবলে নগরজীবন বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে। বাড়িয়ে তুলছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু, বৃদ্ধ ও শ্বাসতন্ত্রের রোগীরা।
প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণে ফুসফুসের অক্সিজেন গ্রহণক্ষমতা কমে শ্বাসকষ্ট ক্রমাগত বাড়ে বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, প্রথমে শ্বাসনালি ও চোখে সমস্যা তৈরি করে। ফলে অ্যাজমা ও নিউমোনিয়ার রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে এ দূষিত বায়ু গ্রহণ ব্রঙ্কাইটিস থেকে ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে বলে উল্লেখ করেন। এদিকে বায়ুদূষণের কারণে ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বেশি দেখা দেয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
এ জন্য বায়ুদূষণের সঙ্গে মানুষের গড় আয়ুর বিষয়টি জড়িত। আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে কিন্তু সেটা কতটা মানসম্মত সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত। আমাদের জীবদ্দশায় কতটা সময় হাসপাতালে কাটাতে হয়, সেটাও হিসাব করা উচিত বলে জানান তারা।
নির্মল বায়ুর জন্য স্থায়ী কোনো নীতি যেটি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে পারে, সেটা গড় আয়ু বাড়ানোর পাশাপাশি জলবায়ুর ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তারা এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে চীনকে উল্লেখ করে বলেছেন, ২০১১ সালের তারা যে নীতি গ্রহণ করেছে, তাতে তাদের গড় আয়ু বেড়েছে ২.৬ বছর।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০৩
আপনার মতামত জানানঃ