আফগানিস্তানে হাহাকার চলছে। খাবারের জন্য হন্যে হয়ে ছুটছে মানুষ। তার ওপর আসছে তীব্র শীত, বাড়ছে শঙ্কা। কারণ, ইতিমধ্যে অনেক এলাকা খরার কবলে পড়েছে। ফলে ফসল উৎপাদনে ধস নামার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছাড়া তালিবান ক্ষমতায় আসার পর দেশটিতে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সামনের দিনগুলোতে ভয়ংকর বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে আফগানেরা। আর এসবের চোট সবচেয়ে বেশি পড়তে যাচ্ছে শিশুদের ওপর। চলতি বছরের শেষ নাগাদ আফগানিস্তানে প্রায় ৩২ লাখ শিশু চরম অপুষ্টির শিকার হতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তাপমাত্রা কমতে শুরু করায় এদের মধ্যে অন্তত দশ লাখ শিশু মারা যেতে পারে। শুক্রবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-এর এক মুখপাত্র এতথ্য তুলে ধরেছেন। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এখবর জানিয়েছে।
দাতব্য সংস্থাগুলো সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, আফগানিস্তানে খরার কারণে একদিকে ফসল উৎপাদন কম হয়েছে। আরেকদিকে পশ্চিমারা আর্থিক সমর্থন প্রত্যাহারের পর অর্থনীতির পতন ঘটেছে। স্বাস্থ্যখাতের অবস্থা একেবারেই শোচনীয়। বেতন না পাওয়ায় অনেক স্বাস্থ্যকর্মী পালিয়ে গেছেন।
কাবুল সফরে থাকা ডব্লিউএইচও মুখপাত্র মার্গারেট হ্যারিস টেলিফোনে বলেন, দেশজুড়ে অনাহার বাড়তে থাকায় এটি একটি কঠিন যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। আফগানিস্তান থেকে বিশ্বের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া উচিত না।
হ্যারিস জানান, রাতে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির নিচে নেমে যাচ্ছে। শীতে বয়স্ক ও শিশুদের বিভিন্ন রোগ দেখা দিতে পারে। কিছু এলাকায় হাসপাতালের জ্বালানির জন্য মানুষ গাছ কাটছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মুখপাত্র মার্গারেট হ্যারিস জানিয়েছেন, রাতে আফগানিস্তানের তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায় এবং শীতকালীন তাপমাত্রার কারণে বৃদ্ধ ও তরুণরা নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারে। হাসপাতালগুলোর ওয়ার্ড ইতোমধ্যে শিশুদের দিয়ে পূর্ণ হয়ে গেছে। এদের মধ্যে সাত মাস বয়সী একটি শিশুও রয়েছে দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে যাকে নবজাতকের চেয়েও ছোট দেখাচ্ছে।
আফগানিস্তানে হামে আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, ২৪ হাজার ক্লিনিক্যাল কেস পাওয়া গেছে।
হ্যারিস বলেন, অপুষ্ঠিতে ভোগা শিশুদের জন্য হাম মৃত্যুদণ্ডের মতো। আমরা যদি দ্রুত উদ্যোগ না নেই তাহলে শিগগিরই আরও অনেক মৃত্যু দেখব।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ২ কোটি ২০ লাখের বেশি আফগানকে সাহায্য করতে হিমশিম খাচ্ছে ডব্লিউএফপি। এরপর যদি সামনের দিনগুলোতে আবহাওয়ার অবস্থা খারাপ হয়, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। শীতের সময় আবহাওয়া খারাপ হওয়ার যে আভাস বিশেষজ্ঞরা দিয়েছেন, সেটা যদি হয় তাহলে বিপুল সংখ্যা মানুষ মারাত্মক ক্ষুধায় ভুগবে এবং সুদূরপ্রসারী দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে।
তালিবান আফগানিস্তান দখল করতেই দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে সামনের মাস থেকেই চরম খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডাব্লিউএফপি) আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছে, দেশটির অর্ধেকেরও বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষের শিকার হতে চলেছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে আগাম সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়েছে। আফগানিস্তানে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৩২ লাখ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগতে পারে বলে মনে করছে ডাব্লিউএফপি।
আফগানিস্তানে দীর্ঘদিন ধরে চলা সংঘাত-সংঘর্ষ-সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে দেশটির শিশুদের ওপর। সম্প্রতি প্রকাশিত উনিসেফের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশটিতে সংঘাতের কারণে প্রাণহানি হয়েছে অন্তত ৪৬০ শিশু। যারা বেঁচে গেছে তারাও ভালো নেই। অনেকে পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
ক্ষতিগ্রস্ত প্রদেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঘোর। সেখানে অপুষ্টির কারণে হাসপাতালে ভর্তি শিশুদের মধ্যে কমপক্ষে ১৭ জন মারা গেছে।
প্রদেশের জনস্বাস্থ্য পরিচালক মোল্লা মোহাম্মদ আহমদী বলেন, ক্ষুধার প্রভাবের জন্য প্রায় ৩০০ জনকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, দেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে শত শত শিশু অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে।
আফগানিস্তানে জাতিসংঘের শিশু সংস্থার একজন মুখপাত্র বলেছেন, তিনি ঘোরের মৃত্যুর সংখ্যা নিশ্চিত করতে পারেননি কিন্তু আশঙ্কা করছেন ‘অনেক শিশু চূড়ান্ত মূল্য দিচ্ছে’।
ইউনিসেফের সালাম আল-জানাবি বলেন, এজেন্সির মনিটরিং নেটওয়ার্ক বিঘ্নিত হয়েছে এবং ঘটনাপ্রবাহের রিপোর্টের উপর নির্ভর করছে; কিন্তু আমরা খুব বেদনাদায়কভাবে সচেতন যে এটি এমন কিছু, আমরা যার দ্বারপ্রান্তে বা মাঝখানে আছি।
আফগানিস্তানে তালিবানের উত্থানের মুখে নিরাপত্তার জন্য অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। যার কারণে অনেক আফগান শিশুকে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হয়েছে। অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে এসব শিশুর স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারগুলো।
চলতি বছরের শেষ নাগাদ আফগানিস্তানে প্রায় ৩২ লাখ শিশু চরম অপুষ্টির শিকার হতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তাপমাত্রা কমতে শুরু করায় এদের মধ্যে অন্তত দশ লাখ শিশু মারা যেতে পারে।
লন্ডনভিত্তিক অধিকার সংগঠন অ্যাকশন অন আর্মড ভায়োলেন্স (এওএভি) জানিয়েছে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে আফগানিস্তানে বিমান হামলায় হতাহত বেসামরিক মানুষের ৪০ শতাংশই শিশু। এ সংখ্যা ১ হাজার ৫৯৮।
এ বিষয়ে সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল আফগানিস্তানের কান্ট্রি হেড ক্রিস নায়ামান্দি বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে আফগানিস্তান শিশুদের জন্য একটি ভয়ংকর প্রাণঘাতী দেশ। তাই দুঃখজনক হলেও সত্য, এ সংখ্যা আমাকে অবাক করে না।’
পশ্চিমা-বিশ্ব সমর্থিত ক্ষমতাসীন সরকারের পতন এবং কট্টর ইসলামপন্থী গোষ্ঠী তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর গভীর সঙ্কটে পড়েছে আফগানিস্তান। তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর দেশটিতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই সঙ্কট আরও তীব্র হয়েছে। আফগানিস্তান অর্থনৈতিক পতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে; যা দেশটিকে নতুন রাজনৈতিক সংকটে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
আফগানিস্তানে খাদ্য সংকটে দিনাতিপাত করছে বেশিরভাগ পরিবার। আগের থেকে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা থাকলেও দেশটি তালিবানের দখলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে চরম অস্থিতিশীলতার দাঁড়প্রান্তে দাঁড়িয়েছে। এরপর থেকে সেখানে খাদ্যের অভাব বিস্তৃত হতে শুরু করে।
আফগানিস্তান বরাবরই গরিব দেশ। সেখানকার ৭০ শতাংশ মানুষের দৈনিক আয় দুই ডলারের কম। অর্থনীতিবিদদের ধারণা, আগামী দিনে দেশটি আরও দরিদ্র হতে চলেছে। সেই দারিদ্রের মোকাবিলা করতে হবে তালিবান শাসকদের। তারা ইতিমধ্যেই বুঝতে পারছেন, দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর চেয়ে বেশি কঠিন।
তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভরশীল আফগান অর্থনীতি আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, একটি দেশের মোট দেশীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি বিদেশি সাহায্য থেকে এলে তাকে সাহায্য নির্ভর দেশ বলে ধরা হয়। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে জিডিপির প্রায় ৪০ শতাংশই ছিল আন্তর্জাতিক সাহায্য। দেশটির দারিদ্র্যের কারণে বহু দিন ধরেই প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশ অর্থ সাহায্য করেছে। কিন্তু এই অস্থির পরিস্থিতিতে কেউই আগের মতো আর্থিক সাহায্য করছে না। ফলে সেখানকার অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। বেহাল অর্থনীতির কারণেই মানুষের দারিদ্র্য চরমসীমায় পৌঁছেছে। তাই অবিলম্বে আন্তর্জাতিক মহল ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে বাধ্য।
আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি যেখানে গিয়ে ঠেকেছে, সেই অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত আফগানদের পাশে এসে দাঁড়ানো। মারাত্মক অনাহারের মুখে থাকা লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষের জীবন বাঁচানো। এ জন্য উন্নত দেশ ও ধনকুবেরদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন ডব্লিউএফপির বিসলেই। তিনি বলেছেন, বিশ্বনেতা থেকে শুরু করে ধনকুবেরদের প্রতি আহ্বান: অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে আপনার ছোট্ট মেয়ে ও ছোট্ট ছেলে, আপনার দাদা-দাদি, নানা-নানির মৃত্যুর কথা আপনারা কল্পনা করুন। আপনাদের সর্বোচ্চ দিয়ে কিছু করা উচিত। ৪০০ ট্রিলিয়ন সম্পদের আজকের এই দুনিয়ায় এভাবে মানুষের মৃত্যু আমাদের জন্য লজ্জার।’
বিসলেই বলেছেন, ‘আমরা যদি অনাহারে কোনো শিশুকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিই, সেটা হবে আমাদের জন্য চরম লজ্জার।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন সন্ত্রাসী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকা তালিবান ভেবেছিল সরকার চালানো বোধহয় খুব সহজ। মানুষ খুন করা আর দেশ চালানো যে এক নয়, সেটা তারা বোঝেনি। দুর্নীতি আর বেহাল অর্থনীতি শুরুতেই কাঁধে চেপে বসেছে তালিবান শাসকদের। অর্থনীতি তো দূরের কথা, শান্তি ফেরাতেও হিমশিম খাচ্ছে দখলদার সরকার। ক্ষমতায় আসার আগে আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তালিবান। বোঝাতে চেয়েছিল, গত দুই দশকে তাদের মানসিকতার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তারা যে বিন্দুমাত্র নিজেদের মানসিকতা বদলায়নি ক্ষমতায় এসেই চরম বর্বরতার পরিচয় দিয়ে তারা সেটা আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক সাহায্যের বহর কমছে।
মনে করা হয়, তালিবানকে সাহায্য করা মানেই জঙ্গিবাদ ও মাদক চোরাকারবারীদের মদদ। আত্মঘাতী বোমারুদের যেমন তারা প্রকাশ্যেই উৎসাহিত করছে, তেমনি ক্ষমতায় আসার পর ফের মাদক ব্যবসার কথাও বলছেন তালিবান মন্ত্রীরা। নারী ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বহরও কমেনি। তাই বেশিরভাগ দেশই তালিবানের ওপর ক্ষুব্ধ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩৯
আপনার মতামত জানানঃ