বৈদেশিক ঋণের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় মনোযোগ দিতে পারছে না বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলো। কারণ এসব দেশের বেশিরভাগ অর্থই ব্যয় হয়ে যায় ঋণশোধে। দারিদ্র্য বিমোচন বিষয়ক দাতব্য সংস্থা জুবিলি ডেট ক্যাম্পেইনের রিপোর্টে এই তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল বুধবার গার্ডিয়ান–এর এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়।
রিপোর্ট মতে, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলার চেয়ে বৈদেশিক ঋণশোধে পাঁচগুণ বেশি অর্থ ব্যয় করছে বিশ্বের নিম্নআয়ের দেশগুলো।
জুবিলি ডেট ক্যাম্পেইনের তথ্য মতে, বৈদেশিক ঋণের পেছনে বিশ্বের সবচেয়ে গরিব ৩৪টি দেশকে প্রতিবছর অন্তত ২ হাজার ৯৪০ কোটি ডলার ব্যয় করতে হয়। এই বিশাল পরিমাণ ব্যয়ের পর তাদের হাতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার মতো অর্থ খুব কমই থাকে। এরপরও এই দেশগুলো প্রতিবছর জলবায়ু খাতে প্রায় ৫০৪ কোটি ডলার খরচ করে।
২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত উগান্ডা জলবায়ু সংকট কাটাতে ব্যয় করেছে মাত্র ৫৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এই অর্থের একটা অংশ ছিল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতাদের কাছ থেকে পাওয়া। অথচ ১০ কোটি ৭৪ লাখ ডলার বাজেট থেকে কাটছাঁটের পরও চলতি বছর তারা ঋণ শোধ করবে ৭৩ কোটি ৯০ লাখ ডলারের। ২০২৫ সালে এটা বেড়ে দাঁড়াবে ১৩৫ কোটি ডলার। দেশটিকে আগামী চার বছর তাদের ঋণের সুদ মেটাতেও বাড়তি অর্থ জোগাড় করতে হবে।
জুবিলি ডেট ক্যাম্পেইন বলছে, গরিব দেশগুলোকে ধনী দেশগুলোর তুলনায় ঋণের ওপর বেশি সুদও দিতে হয়। ধনী দেশগুলোকে যেখানে দেড় থেকে আড়াই শতাংশ হারে সুদ দিতে হয়, গরিব দেশগুলোর ক্ষেত্রে এ হার ১০ শতাংশের বেশি।
জুবিলি ডেট ক্যাম্পেইনের নির্বাহী পরিচালক হেইডি চাও বলেন, নিম্ন আয়ের দেশগুলো এখন বিভিন্ন ধনী দেশ, ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে নেওয়া ১০০ কোটির বেশি ডলারের ঋণ শোধ করছে। অথচ এখন তাদের জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়া দরকার। তিনি জানান, আগামী রোববার শুরু হতে যাওয়া জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬-এ গরিব দেশগুলো বিষয়টি তুলে ধরবে।
এদিকে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠেয় জলবায়ু সম্মেলনের আগমুহূর্তে জাতিসংঘ সতর্ক করে বলেছে, বর্তমান প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যে হারে কার্বন নিঃসরণ কমানো হবে, তাতে চলতি শতকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা গড়ে ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএসইপি) গত মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এই সতর্কতা দেয় বলে রয়টার্স জানায়।
বৈদেশিক ঋণের পেছনে বিশ্বের সবচেয়ে গরিব ৩৪টি দেশকে প্রতিবছর অন্তত ২ হাজার ৯৪০ কোটি ডলার ব্যয় করতে হয়। এই বিশাল পরিমাণ ব্যয়ের পর তাদের হাতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার মতো অর্থ খুব কমই থাকে। এরপরও এই দেশগুলো প্রতিবছর জলবায়ু খাতে প্রায় ৫০৪ কোটি ডলার খরচ করে।
স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে আগামী সপ্তাহের জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনকে সামনে রেখে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস এটাকে ‘জেগে ওঠার ডাক’ বলে অভিহিত করেছেন। আগামী সপ্তাহের সম্মেলনের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রাক-শিল্পযুগের তুলনায় দেড় থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার এটিই শেষ সুযোগ।
গত আগস্টে প্রকাশিত জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বন্যা, খরা, দাবানলের মতো চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আক্রান্ত হচ্ছে। এ ধরনের দুর্যোগের পরিমাণ সময়ের সঙ্গে শুধু বাড়ছে। এসব দুর্যোগের পেছনে মুখ্য কারণ হিসাবে রয়েছে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের কারণে হওয়া বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও সেই সূত্রে হওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে।
ইউএন এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের (ইউএনইপি) গত মঙ্গলবার প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ পরিণতি মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য হারে গ্রিনহাউজ গ্যাস কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিশ্বের অন্তত দু’শ দেশ। কিন্তু তাদের সেই প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতার মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান দেখা যাচ্ছে। কয়েকদিন পরই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জলবায়ু বিষয়ক আরও একটি বড় সম্মেলন। কিন্তু এখন পর্যন্ত বেশ কিছু ধনী দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কার্বন নিঃসরণের নতুন পরিকল্পনা প্রকাশ করেনি। বিশ্বের সিংহভাগ অর্থাৎ ৮০ ভাগ কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী জি২০ ভুক্ত দেশগুলো। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্তত ছয়টি দেশ কখনই তাদের নিজ নিজ প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি। অন্য পাঁচটা দেশ হচ্ছে— কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ কোরিয়া ও মেক্সিকো। তবে এই দেশগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কার্বন নিঃসরণ পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু মুখেই বড় বড় কথা। কাজের বেলায় ঠনঠন। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ক্ষেত্রে বাস্তবতা এখন এমনই। কার্বন বা গ্রিসহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে একের পর এক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিশ্বের বড় বড় দেশগুলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো কাজই তারা করেনি। উলটো এই দেশগুলোতেই দ্রুতগতিতে বেড়েছে কার্বন নিঃসরণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, পৃথিবীর আবহাওয়া পাল্টে যাবার কথা অনেকদিন থেকেই আলোচনায়। বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছিলেন। ওজোনস্তর ফুটো হয়ে যাবার কথাও অনেক পুরোনো। কিন্তু সেই পুরোনো কথার গুরুত্ব কেউ দেয়নি। আর দিলেও তা যে যথাযথভাবে দেওয়া হয়েছে, এমন বলার সুযোগ নেই।
বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা মানুষ শুনেছে। রাষ্ট্রপ্রধানরা তহবিল সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন ফোরামের নানা আয়োজনে উত্তেজক কথাবার্তা বলে হাততালি নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন। একে অন্যকে দোষারোপের সংস্কৃতিও রয়েছে। আর ধনী রাষ্ট্রগুলো যেভাবে কার্বন নিঃসরণ করছে, তার বিপরীতে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো রীতিমতো অসহায়। ফলে একদিকে দোষারোপের সংস্কৃতি, দরিদ্র দেশগুলোর আহাজারি, পৃথিবীব্যাপী সচেতন মানুষদের আর্তনাদ অন্যদিকে বায়ুমণ্ডলে অবিচ্ছিন্নভাবে কার্বন নিঃসরণ চলতে থাকে। ফলে বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তাও ফলতে শুরু করেছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে, হিমালয়ের বরফ গলছে। সেই পানি ধেয়ে আসছে সমুদ্রে। বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। আর ওজোনস্তরের ফুটো বাড়তে থাকারও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
বিশ্বের তাপমাত্রার যে পরিবর্তন তাও স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। পেছনের একশ বছরের তাপমাত্রা মিলিয়ে দেখে, বায়ুমণ্ডল এবং পৃথিবীপৃষ্ঠ উষ্ণ হয়ে ওঠার প্রমাণও হাতেনাতে ফলতে শুরু করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দুর্ভাগ্য, পৃথিবীর তাপমাত্রা অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ঠিক করার কাজটি নিয়ে যত সময়ক্ষেপণ হবে, মতানৈক্য থাকবে, তত বেশি মোকাবেলা করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। সেই ঝুঁকি এড়ানোর পথ একটাই, সেটা হল শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোকে এক টেবিলে বসিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৬
আপনার মতামত জানানঃ