দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর আঞ্চলিক জোট আসিয়ানের ৩৮ ও ৩৯তম শীর্ষ সম্মেলনে মিয়ানমারের সেনাশাসক সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং দেশটির প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না। তার পরিবর্তে একজন আমলা জোটের শীর্ষ বৈঠকে দেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন। সংস্থাটির এ ঘোষণার পর প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি বন্দি মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দেয় দেশটির জান্তাপ্রধান। সে হিসাবে তাদের মুক্তিও করে দেওয়া হয়। কিন্তু আসিয়ানের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ না পাওয়ায় মুক্তি দেওয়া বন্দিদের আবারও গ্রেপ্তার শুরু করেছে জান্তা সরকার।
গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। এরপর থেকেই বিক্ষোভে উত্তাল দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশটি। সেখানে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভে এ পর্যন্ত অন্তত ১ হাজার ১০০ জন নিহত এবং আট হাজারের বেশি মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে জানিয়েছে অ্যাসিসট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স (এএপিপি) নামে একটি সংগঠন।
গত সোমবার (১৮ অক্টোবর) মিয়ানমার জান্তা জানিয়েছিল, তারা বৌদ্ধদের তিন দিনব্যাপী থাদিংযুত উৎসব চলাকালে পাঁচ হাজারের বেশি বন্দিকে মুক্তি দেবে। এ খবরের পরপরই কারাগারগুলোতে ছুটে যান বন্দিদের পরিবারের সদস্যরা।
জান্তা সরকার এখন পর্যন্ত ঠিক কতজনকে মুক্তি দিয়েছে, তার প্রকৃত সংখ্যা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে এএফপির খবর অনুসারে, কেবল আর কখনো জান্তার বিরোধিতা করবেন না এমন শর্ত দেওয়া দলিলে সই করার পরেই ছাড়া পেয়েছেন কয়েকজন।
এএপিপি জানিয়েছে, মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে অন্তত ১১০ জনকে আবারও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) এক বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, কয়েকজন বাড়িতে পৌঁছানোর পরপরই ফের গ্রেপ্তার হয়েছেন। মুক্তিপ্রাপ্তদের তালিকায় রয়েছেন জানিয়ে কিছু লোককে জেলগেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকে বাড়তি অভিযোগ দায়ের করে তাদের আবারও কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারির সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকেই অরাজক পরিস্থিতি চলছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমারে। গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে হওয়া বিক্ষোভ দমনে শক্তি প্রয়োগ করে সেনাবাহিনী, যাতে নিহত হয় প্রায় এক হাজার ২০০ জন বেসামরিক মানুষ।
এএপিপির ওয়েবসাইটে উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান করায় ফেব্রুয়ারি থেকে প্রায় নয় হাজার বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এ সময়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে। এর প্রেক্ষিতে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে নিন্দার ঝড় বইতে থাকে। চাপ আসতে থাকে। সামরিক সরকারের নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবরোধ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তার সঙ্গে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে আসিয়ানের অবস্থান। তারা কার্যত আসিয়ান সম্মেলনে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার কোনো প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ না জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ, গত এপ্রিলে মিয়ানমার আসিয়ানে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সহিংসতা বন্ধে পদক্ষেপ নেয়া। মানবিক সহায়তা দেয়ার পথ উন্মুক্ত করা এবং বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা। এর মধ্যে কোনোটিই বাস্তবায়ন করেনি সামরিক জান্তা।
ফলে গত সপ্তাহে আসিয়ানের আসন্ন সম্মেলন নিয়ে জোটের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা জরুরি বৈঠকে বসেন। তাতেই সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়— মিয়ানমারের সামরিক জান্তার কোনো প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হবে না। আমন্ত্রণ জানানো হবে অরাজনৈতিক প্রতিনিধিকে। আসিয়ানের মূলমন্ত্র এক দেশ অন্য দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না— হলেও গ্রুপটি এমন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ওই বৈঠকের পর মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বলেছে, এই সিদ্ধান্ত আসিয়ানের দীর্ঘদিনের আচরিত নীতিবিরোধী।
গত সপ্তাহে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০ দেশের জোট আসিয়ান মিয়ানমারের সেনাপ্রধানকে বাদ দিয়েই শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপরই থাডিংইয়ুৎ উৎসবের তিনদিনজুড়ে হাজারো বন্দিকে মুক্তির ঘোষণা দেন মিন অং হ্লাইং।
মিয়ানমারের রাজনীতিতে রক্তক্ষয়ী অচলাবস্থা নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থতার অভিযোগে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে এ সিদ্ধান্ত নেয় আঞ্চলিক জোটটি।
গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশের শাসনব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ নেয়ার প্রায় নয় মাস পর এখন সবচেয়ে চাপে রয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাউন্সিলর ডেরেক শলেট বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের কাছে আসিয়ানের বিরল এ পদক্ষেপের প্রশংসা করেন। আঞ্চলিক বিভিন্ন সংকটে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতার অভিযোগে দীর্ঘদিন ধরেই নখদন্তহীন হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে আসছে আসিয়ান।
মিয়ানমারের জান্তা সরকারের ওপর চাপ বাড়ানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সঙ্গে আলোচনায় অঞ্চলটিতে সফর করছেন শলেট।
গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশের শাসনব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ নেয়ার প্রায় নয় মাস পর এখন সবচেয়ে চাপে রয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।
সমালোচকরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে মূলত আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে চাপ এড়াতে কৌশলী হয়েছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। কৌশলের অংশ হিসেবেই বহির্বিশ্বের চোখে ধুলো দিতে সাধারণ ক্ষমার আওতায় বন্দিদের মুক্তি দেয়া আর বিরোধীদের আলোচনার প্রলোভন দেখিয়েছে সামরিক জান্তা।
এদিকে মিয়ানমারে মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিউর টম অ্যানড্রুজ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের কাছে আর্জি জানিয়েছেন। বলেছেন, মিয়ানমারের সামরিক জান্তার অর্থ, অস্ত্র এবং বৈধতাকে জিম্মি করে রাখা উচিত। তাদের কর্মকাণ্ডকে অস্বীকার করা উচিত। মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার একটি রেজ্যুলুশন পাস করাতে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
আরো বলেন, এসব পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। কারণ, অস্ত্র এবং প্রযুক্তির দ্বৈত ব্যবহারের ফলে জান্তা সরকারের কাছে অস্ত্র বিক্রি হচ্ছে এবং তা তাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। এ ছাড়া মিয়ানমারের তেল ও গ্যাস বিষয়ক উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে অবরোধ দেয়ার আহ্বান জানান টম অ্যানড্রুজ।
তিনি উল্লেখ করেন, এসব খাত থেকে সামরিক সরকারের কাছে সবচেয়ে বড় অংকের রাজস্ব আসছে। সতর্কতা দিয়ে তিনি আরো বলেন, মিয়ানমারে আরো রক্তপাত হওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ, সরকার দেশটির উত্তরাঞ্চলে হাজার হাজার সেনা সদস্য, ভারি অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে। ওই অঞ্চলে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে বিদ্রোহীরা। তাদেরকে শায়েস্তা করতে এমন উদ্যোগ নিয়েছে সামরিক জান্তা।
তার ভাষায়, দুর্ভাগ্যজনক হলো আমরা আরেকটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে। এতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নিরপরাধ মানুষের প্রাণ যেতে পারে। ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হতে পারে। একই সঙ্গে চিন এবং কায়া রাজ্যে সেনাবাহিনীর এই অগ্রযাত্রার বিষয়ে সতর্ক করেছে বিরোধীদের সরকার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি)।
এদিকে আসিয়ান সম্মেলনে অরাজনৈতিক নেতৃত্বকে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। কে হবেন মিয়ানমারের সেই অরাজনৈতিক প্রতিনিধি, তা এখনও স্পষ্ট জানা যায়নি। আগামী ২৬ থেকে ২৮ শে অক্টোবর ব্রুনাইয়ে হতে যাচ্ছে ১০ সদস্য বিশিষ্ট এসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশন্সের (আসিয়ান) বার্ষিক সম্মেলন। মিয়ানমার এর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও জোর করে ক্ষমতায় আসা সামরিক জান্তাকে এতে আমন্ত্রণ না জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আসিয়ান নেতারা। এতে ক্ষোভ জানিয়ে শুক্রবার বিবৃতি দিয়েছে সামরিক জান্তা সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
তাতে বলা হয়েছে, আসিয়ানের অন্য ১০টি সদস্য যেসব অধিকার ভোগ করে, সম্মেলনে যোগ দেয়ার অধিকার ভোগ করে, মিয়ামনারের সরকার প্রধানেরও সেই সমান অধিকার আছে।
এতে আরো বলা হয়েছে, আসিয়ান সনদের বিধিবিধান, উদ্দেশ্য ও লালিত নীতির বিরুদ্ধে যেকোনো আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত মেনে নেবে না মিয়ানমার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২৮
আপনার মতামত জানানঃ