মাদক নির্মূলে পুলিশ সদস্যরা একের পর এক অভিযান চালালেও পুলিশের কোন কোন সদস্যের বিরুদ্ধে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি মাদক ব্যবসায়ও তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, খোদ পুলিশ বাহিনীর কাছ থেকেই নানা সময়ে পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মাদক সেবনের তথ্য পাওয়া গেছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) আশঙ্কাজনক হারে মাদকাসক্ত সদস্য সংখ্যা বাড়ছে। ফলে মাদক নিয়ে পুলিশ বিভাগে চলছে গোপন অনুসন্ধান। ইতোমধ্যে তিনশ’ পুলিশ সদস্যকে শনাক্ত করে ৯০ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আরও শতাধিক সদস্য চাকরি হারানোর তালিকায় রয়েছেন। পুলিশ বিভাগকে মাদক সেবনে বিরত রাখার জন্য নিয়মিত রোলকলের মাধ্যমে এ ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ।
২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সময়ে চাকরি হারিয়েছেন পুলিশের এই সদস্যরা।
চাকরিচ্যুত সদস্যদের মধ্যে কনস্টেবলদের সংখ্যাই বেশি। আরও আছে উপপরিদর্শক (এসআই), সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই), সার্জেন্ট ও নায়েক।
গত ৭ অক্টোবর ডিএমপি সদরদপ্তর থেকে তার অধীনে সব ইউনিটে পাঠানো চিঠিতে চাকরিচ্যুতির এ তথ্য জানা গেছে।
ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলামের পক্ষে চিঠিটি ইস্যু করেছেন প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড ইন্টারনাল ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপকমিশনার ফরিদা ইয়াসমিন। ফরিদা ইয়াসমিন স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পুলিশের সব থানাসহ ৫৭ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সারাদেশেই পুলিশ সদস্যদের নিয়মিত রোলকলের আওতায় আনা হচ্ছে। পাশাপাশি সারাদেশে মাদকবিরোধী অভিযান আরও কঠোর করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো।
পুলিশের ৫৭ বিভাগে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ঢাকায় কর্মরত পুলিশ বা সিভিল সদস্যদের মাদকদ্রব্য সেবন এবং শৃঙ্খলাজনিত কারণে প্যাথলজিক্যাল রিপোর্টের প্রেক্ষিতে এ পর্যন্ত ৯০ পুলিশ সদস্যকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে আপনার অধীনে কর্মরত সকল পুলিশ/সিভিল সদস্যকে মাদক সেবন থেকে বিরত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিয়মিতভাবে রোলকলের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হলো।
মাদক সেবনের অভিযোগে চাকরিচ্যুতির পাশাপাশি মাদক কারবারে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
পুলিশ সদস্যদের যাতে মাদক সেবন থেকে দূরে রাখা যায় সে লক্ষ্যে নিয়মিত রোল কলের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিয়েছে ডিএমপি সদরদপ্তর।
শফিকুল ইসলাম ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকার পুলিশ কমিশনার দায়িত্ব নেয়ার পর ডিএমপির সদস্যদের ডোপ টেস্ট করানোর ঘোষণা দেন। এরপরই সন্দেহভাজন পুলিশ সদস্যদের টেস্ট করানো শুরু হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, প্রথম পর্যায়ে কনস্টেবল থেকে সাব-ইন্সপেক্টর পর্যন্ত ডোপ টেস্টের আওতায় আনা হচ্ছে। কাউকে সন্দেহ হলেই তাকে ডোপ টেস্ট করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আওতায় আনা হবে। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের কিছু সদস্য মাদক কারবারিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। এর পাশাপাশি অনেকে মাদক সেবনও করছেন। এমনকি কেউ কেউ মাদক কারবার করছে। সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে অভিযান চালিয়ে কয়েক পুলিশ সদস্যকে মাদক কারবার ও সেবনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইতোমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে কঠোর নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে, মাদকবিরোধী অভিযান জোরালো করার পাশাপাশি যেসব পুলিশ সদস্য মাদকাসক্ত বা মাদক কারবারে জড়িত তাদের চিহ্নিত করতে। নির্দেশনা পেয়ে কাজ শুরু করা হয়েছে। ডোপ টেস্টে যাদের পজিটিভ পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নিদের্শনা দেয়া হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) আশঙ্কাজনক হারে মাদকাসক্ত সদস্য সংখ্যা বাড়ছে। ফলে মাদক নিয়ে পুলিশ বিভাগে চলছে গোপন অনুসন্ধান। ইতোমধ্যে তিনশ’ পুলিশ সদস্যকে শনাক্ত করে ৯০ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আরও শতাধিক সদস্য চাকরি হারানোর তালিকায় রয়েছেন।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডিএমপি জানায়, ৮১ জন পুলিশ সদস্য মাদক নেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তাদের মধ্যে ৬০ জনই কনস্টেবল। এ ছাড়া একজন পরিদর্শক, আটজন এসআই, ট্রাফিকের একজন সার্জেন্ট, নায়েক ছয়জন এবং এএসআই আছেন পাঁচজন।
পরে ৯ মাসে মাদক সেবনের অভিযোগে আরও ৯ জন সদস্য চাকরি হারান।
পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে থাকা মাদকাসক্ত সদস্যদের চিহ্নিত করার জন্য ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্সের ইন্টেলিজেন্স অ্যানালাইসিস ডিভিশন (আইএডি) বিশেষভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
এ ছাড়া স্ব স্ব ইউনিটে সন্দেহভাজন মাদকাসক্তদেরও তালিকা করছেন ঊর্ধ্বতনরা। এসব তালিকায় থাকা সদস্যদের আচরণ সন্দেহভাজন হলে বা মাদকসক্ত মনে হলে স্ব স্ব ইউনিটের মাধ্যমে রাজারবাগে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে।
সেখানে শরীর থেকে নমুনা নিয়ে মাদক গ্রহণ করেছে কি না সেজন্য ডোপ টেস্ট করা হয়। ফলাফল পজেটিভ আসলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়ে থাকে।
ডিএমপির একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ২০২০ সালের মাঝামাঝিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে ডোপ টেস্ট শুরু হয়। প্রথম অবস্থায় ৩০ সদস্য শনাক্ত হওয়ার পর তদন্ত শেষে ১০ জনকে সাসপেন্ড করা হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে আরও একাধিক সদস্য শনাক্ত হলে পুলিশের ভেতর এক ধরনের ডোপ টেস্ট আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এই উদ্যোগকে বেশিরভাগ পুলিশের সদস্যই সাধুবাদ জানান।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিটি থানায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সে হিসেবে মাদকাসক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত এ্যাকশনে নামছে মনিটরিং টিম। পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে ডোপ টেস্টের ফলাফলের ভিত্তিতে তাদের শনাক্ত করে চাকরিবিধি মেনে বাহিনী থেকে বরখাস্ত করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে পুলিশের সকল ইউনিটে ও সকল রেঞ্জে ডোপ টেস্ট ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ডোপ টেস্ট আতঙ্ক।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আসা অব্যাহত রয়েছে। কোথাও কোথাও মাদকের সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকার অভিযোগ আসে পুলিশের বিরুদ্ধে, কোথাওবা অস্ত্র বিক্রয়কারী হিসাবে, কোথাওবা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ, অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ, পুলিশের নেতৃত্বে মাদক পাচার চক্র গড়ে ওঠার অভিযোগ, চুরি ডাকাতি ইত্যাদি হেন কোনো অপরাধ নেই যা পুলিশ শব্দটির সাথে জুড়ে বসে নাই। প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে এমনসব অভিযোগ আসে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুলিশের বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার হার আশংকাজনক। প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে বিভিন্ন অপকর্মের। এবিষয়ে পুলিশের কর্তৃপক্ষসহ দেশের সরকাকেও নজর বাড়াতে হবে। কেননা, আইন রক্ষাকারী কর্তৃক একেরপর এক আইন বিরোধী কর্মকাণ্ডে দেশের আইনের প্রতি মানুষের অনাস্থা জন্মাবে। ফলশ্রুতিতে দেশে দেখা দিবে বিশৃঙ্খলা।
সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনের খড়্গ চালানোর আগে পুলিশের ওপর চালানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। তারা বলেন, আগে পুলিশকে অপরাধমুক্তের চরিত্র অর্জন করতে হবে। নইলে সন্ত্রাসীদের নিকট পুলিশের যে ভাবমূর্তি সৃষ্টি হচ্ছে, এতে পুলিশ আর সন্তাসীদের মধ্যকার তফাৎ ঘুচে যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২২
আপনার মতামত জানানঃ