করোনাভাইরাস সংক্রমণ এখন বৈশ্বিক মহামারি। যেকোনো বৈশ্বিক মহামারির প্রভাব কেবল সেই রোগের সংক্রমণ, চিকিৎসা আর প্রতিরোধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বৈশ্বিক মহামারি পরিবর্তন করে মানুষের মনোজগৎ। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনেও এর ঢেউ এসে পড়ে। এ সময় রোগ সংক্রমণ আর অসুস্থ হয়ে যাওয়ার ভয় থেকে মৃত্যুভীতি, অবসাদে ভোগা, উদ্বিগ্ন হওয়া, হঠাৎ রেগে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, মহামারির প্রথম বছরেই বিশ্বব্যাপী হতাশা ও উদ্বেগের ঘটনা এক চতুর্থাংশের বেশি বেড়েছে। বিশেষ করে নারী এবং তরুণদের মধ্যে তা বেশি প্রভাব ফেলেছে।
২০২০ সালে করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলেছে তা বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা। তারা অনুমান করছেন মহামারির প্রথম বছরেই ৫ কোটি ২০ লাখ মানুষ গভীর বিষণ্ণতায় ভুগছেন এবং অতিরিক্ত ৭ কোটি ৬০ লাখ মানুষের উদ্বেগ বেড়েছে। খবর এনডিটিভির।
শনিবার দ্য ল্যানসেট মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, হতাশা এবং উদ্বেগ ২৬ থেকে ২৮ শতাংশ মানুষের মাঝে প্রভাব ফেলেছে।
২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান শহরে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। বর্তমানে ২১০টি দেশে এই রোগটির বিস্তার ঘটেছে। এতে প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো বেশি মানসিক সমস্যায় ভুগেছে। করোনার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের একটা সম্পর্ক রয়েছে। চলাচলের উপর বিধিনিষেধ মানুষের বিষণ্নতা এবং উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন গবেষকরা।
কুইন্সল্যান্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের প্রধান গবেষক ড্যামিয়ান স্যান্টোমারো বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় বিশ্বব্যাপী বিষণ্ণতাজনিত এবং উদ্বেগজনিত ব্যাধিগুলো মোকাবেলায় মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে।’
গবেষক আরও বলেন, করোনার কারণে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার অতিরিক্ত চাহিদা পূরণ করা চ্যালেঞ্জিং হবে। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া উচিত হবে না।
উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং পূর্ব এশিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগ কমাতে একটি মডেল তৈরি করেছেন।
গবেষকরা বলছেন, মহামারি না হলে ১৯ কোটি ৩০ লাখ হতাশার ঘটনা ঘটতো। কিন্তু মহামারির কারণে ২০২০ সালে ২৪ কোটি ৬০ লাখ হতাশার ঘটনা ঘটেছে।
একইভাবে ৩৭ কোটি ৪০ লাখ উদ্বেগের ঘটনা ঘটেছে ২০২০ সালে।
২০২০ সালে করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলেছে তা বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা। তারা অনুমান করছেন মহামারির প্রথম বছরেই ৫ কোটি ২০ লাখ মানুষ গভীর বিষণ্ণতায় ভুগছেন এবং অতিরিক্ত ৭ কোটি ৬০ লাখ মানুষের উদ্বেগ বেড়েছে।
মহামারিতে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা
করোনা মহামারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। শিক্ষার্থীভিত্তিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান আঁচল ফাউন্ডেশনের এক জরিপ বলছে, এ হার ৮৪ দশমিক ৬ শতাংশ। যাদের মধ্যে পুরুষ শিক্ষার্থীর তুলনায় নারী শিক্ষার্থীরা এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন বেশি।
গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর দেশের ২ হাজার ৫৫২ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর ওপর চালানো ওই জরিপে এসব তথ্য উঠে আসে।
এতে দেখা যায়, মহামারিতে পুরুষ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮০ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং নারীরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন।
এছাড়াও মহামারিতে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ হারিয়েছেন ৭৫ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। অনলাইন শিক্ষা নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার ব্যাপারে লাইকার্ট স্কেলে ১-৫ স্কোরের মধ্যে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ৩১ দশমিক ৯ শতাংশ অত্যন্ত অসন্তুষ্টি এবং ২১ দশমিক ৬ শতাংশ অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
জরিপে অংশ নেওয়া ১ হাজার ৫৪১ জন অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথা ভেবে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন বলে মনে করেন। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে ১ হাজার ৫৩৭ জন শিক্ষার্থী একাকিত্বকে দায়ী করেছেন। ১ হাজার ৫৮ জন শিক্ষার্থী সেশনজটকে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ১ হাজার ২৮ জন টিউশন চলে যাওয়ায় এবং আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে মানসিক অশান্তিতে ভুগছেন।
মহামারিতে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য ১ হাজার ৫৮১ জন শিক্ষার্থী মুভি বা ওয়েব সিরিজ দেখেছেন। সরাসরি অথবা ভার্চুয়ালি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন ১ হাজার ৯ জন। গান শুনেছেন ১ হাজার ৫ জন। ধর্মীয় দিকে মনোনিবেশ করে নিজের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নতি করেছেন ৯৭৪ জন। বই পড়েছেন ও অনলাইন কোর্স করেছেন যথাক্রমে ৯৭৭ জন ও ৭৯৫ জন। অনলাইনে গেম খেলেছেন ৭২৩ জন, খেলাধুলা করেছেন ৬৪১ জন।
মহামারিতে ঘুমের সমস্যা হয়েছে ৭৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে দেখা যায় ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী যথাযথভাবে ঘুমাননি।
লকডাউন পরিস্থিতিতে অনলাইন ক্লাসসহ অন্যান্য কারণে ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা স্ক্রিনে সক্রিয় থেকেছেন। ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা স্ক্রিনে সময় দিয়েছেন ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা সময় ব্যয় করেছেন ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী।
জরিপে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ৯৮ দশমিক ৩ শতাংশ দীর্ঘ সময় স্ক্রিনের সামনে থাকায় বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। যা তাদের মানসিক এবং শারীরিক ক্ষতির কারণ।
বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে ৫৬ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী মাথাব্যথা এবং চোখে ঝাপসা দেখার সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। ঘুমের সমস্যা হয়েছে ৫১ শতাংশ শিক্ষার্থীর, চোখের সমস্যা হয়েছে ৩৩ দশমিক ১ শতাংশের, অনিয়মিত খাদ্যাভাস হয়েছে ৩৮ দশমিক ২ শতাংশের, ঘাড়, হাত ও পিঠের ব্যথা হয়েছে ৪০ দশমিক ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থীর। ওজন বেড়েছে ৩০ দশমিক ৪ শতাংশের, পারিবারিক দূরত্ব বেড়েছে ২১ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর এবং মাইগ্রেন এর ব্যথা হয়েছে ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর। দীর্ঘ সময় স্ক্রিনের সামনে বসে থাকায় ৫৯ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর মনোযোগ বা স্মৃতিশক্তি কমে গেছে।
জরিপের দেখা যায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তুলনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। এই সময়ে ৮৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং ৮০ দশমিক ৬ শতাংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার বিধ্বংসী ছোবলে কীভাবে মানুষ সংক্রমিত হয়েছে, কীভাবে মারা গেছে, লাশ বহন করা হয়েছে কীভাবে, স্বজনবিহীন লাশ কবরে/শ্মশানে চলে যাচ্ছে কীভাবে, প্রায় স্বজনহীন জানাজা ছাড়া লাশ কবরে চলে গেছে কীভাবে, নিজেকে কীভাবে আড়াল করেছি আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে—এসব কথা মনে পড়বে। মনে পড়লে আমরা মানসিকভাবে আক্রান্ত হব। আমাদের মধ্যে বিষণ্নতা হানা দিতে পারে। এ ধরনের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি দীর্ঘকাল চলার কারণে কিংবা চলতে থাকলে ক্রমান্বয়ে মানুষ বিষণ্নতার দিকে ঝুঁকিতে পড়বে, পড়ছে। পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ-অর্ডারেও ছেয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যেতে পারে জীবনের আনন্দময় অধ্যায়। যথাসময়ে যথাযথ চিকিৎসা না পেলে দিনে দিনে পরিস্থিতি জটিল হতে থাকবে।
করোনাকালে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে বিশ্ব জুড়ে। বিধ্বংসী এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা দুষ্কর। বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, হারাচ্ছেন। বহু ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান বসে গেছে, একদলের চাকরি চলে যাচ্ছে—বিশ্ব জুড়ে দলে দলে কর্মজীবী মানুষ বেকার হয়েছে। আর এসব উদাহরণই সৃষ্টি করেছে বিষণ্নতা।
তারা বলেন, করোনাকালে ঘরে ঘরে চলেছে পারিবারিক সহিংসতা। নারী নির্যাতন বেড়েছে, শিশু নির্যাতন বেড়েছে, যৌন নিপীড়ন বেড়েছে। মানুষের সহিংস আচরণ বেড়েছে। এই আচরণ ভোগ করতে করতে মেয়েদের অধিকাংশই বিষণ্নতা রোগে আক্রান্ত হয়েছে, পুরুষরাও এ আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি। বিষণ্নতার সঙ্গে থাকতে পারে বিরক্তি কিংবা ভয়ের অনুভূতি। দৈহিক উপসর্গের সমাহারও।
আরও বলেন, ‘করোনাকালে মানুষের জীবনযাত্রা থেমে গেছে। শিক্ষার্থীরা তাদের বন্ধুদের সঙ্গে তেমনভাবে মিশতে পারেনি, কথা বলতে পারেনি। তাদের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ,হতাশা, একাকিত্ব কাজ করেছে। তাছাড়া দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় তাদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা কাজ করেছে। অনেকে অর্থনৈতিক সমস্যায় ভুগেছেন। পরিবারের সব সদস্যদের বাড়ির মধ্যে একসঙ্গে বন্দি অবস্থার মতো জীবন যাপন করতে হয়েছে। এসব সমস্যার কারণেই শিক্ষার্থীদের মহামারির এই সময়ে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা হয়েছে।’
আরও বলেন, ‘এই সমস্যা একদিনে সমাধান করা সম্ভব না। এখন যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলছে তাই শিক্ষকদের উচিত হবে শিক্ষার্থীদের চাপ না দিয়ে তাদের পাশে থাকা। তাদেরকে সময় দেওয়া। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪১
আপনার মতামত জানানঃ