অভাব-অনটন বেশি থাকা এবং আয়-উপার্জনের সুযোগ কম থাকায় প্রতিবছর বহু বাংলাদেশি বিদেশে পাড়ি জমান। সাম্প্রতিক সময়ে পুরুষের পাশাপাশি বিদেশগামী নারী কর্মীর সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। তারা যান মূলত মধ্যপ্রাচ্যে এবং গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে। কিন্তু সেখানে নারী কর্মীরা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
প্রবাসে কাজের জন্য যাওয়া নারী কর্মীদের ওপর করোনা মহামারির প্রভাব যাচাইয়ে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) পরিচালিত এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে, পরিবারের ভাগ্য বদলাতে বিদেশে কাজ করতে গিয়ে কর্মস্থলে শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন ৩৫ শতাংশ নারী কর্মী। মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার ৫২ শতাংশ আর যৌন নিপীড়নের শিকার ১১ শতাংশ নারী। নিয়োগকর্তা ও তার স্ত্রীর হাতে এসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। দেশে ফিরে তালাক, অসুস্থতা, সামাজিক কলঙ্কসহ নানা সমস্যার মধ্যে পড়েছেন ২২ ভাগ নারী।
করোনার সময় দেশে ফিরে আসা ৯২ জন নারী কর্মী ও বিদেশে থাকা নারী কর্মীদের পরিবারের ৬১ সদস্যের ওপর সমীক্ষাটি করা হয়। এর মধ্যে সৌদিপ্রবাসী ১০১ জন, বাকিরা বিভিন্ন দেশের। বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এর ফল প্রকাশ করা হয়।
রামরুর সমীক্ষা বলছে, করোনা অতিমারির প্রভাবে আয় কমে যাওয়া, পরিবারের সদস্যদের হাতে নির্যাতনসহ নানা সমস্যায় পড়েছেন ৯২ শতাংশ প্রবাসী নারী। দেশে ফিরে স্বামীর হাতে নির্যাতিত হয়েছেন ৪৯ শতাংশ নারী।
সমীক্ষা বলছে, বিদেশে যেতে নারীরা গড়ে ৫১ হাজার ৭২৮ টাকা খরচ করেছেন। করোনার আগে গড়ে তাদের মাসিক বেতন ছিল ২২ হাজার ৩৩১ টাকা, করোনায় কমে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ২৪৬ টাকা। করোনার আগে নিয়মিত বেতন পেতেন ৬১ ভাগ নারী। করোনার মধ্যে এটি নেমে এসেছে ৪৭ শতাংশে। বেতন বকেয়া রেখে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন ৫৫ শতাংশ নারী।
এ ছাড়া করোনার প্রভাবে কর্মীদের আয় কমেছে, কিন্তু বেড়েছে কাজের চাপ ও সময়। করোনার আগে ৯২ শতাংশ পরিবারে নিয়মিত প্রবাসী আয় এলেও মহামারি শুরুর পর ৯৭ শতাংশ পরিবার নিয়মিত অর্থ পায়নি। আগে ৮৫ ভাগ পরিবারে প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে পারলেও করোনার পর ৯৫ ভাগ পরিবার তা পারেনি বলে সমীক্ষায় বলা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে শ্রম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, সৌদিতে নারী গৃহকর্মীদের নির্যাতনের অভিযোগ আছে। অভিবাসন খাতে অনেক কাজ করছে সরকার। তবে সব ক্ষেত্রেই আমলাতন্ত্র বড় বাধা।
দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্স। প্রায় সোয়া কোটি বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছেন। আগে শুধু পুরুষরাই কাজের জন্য বিদেশে যেতেন; কিন্তু গত এক দশকে অনেক নারী শ্রমিকও এসব দেশে বিশেষত গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করার জন্য যাচ্ছেন।
করোনা অতিমারির প্রভাবে আয় কমে যাওয়া, পরিবারের সদস্যদের হাতে নির্যাতনসহ নানা সমস্যায় পড়েছেন ৯২ শতাংশ প্রবাসী নারী। দেশে ফিরে স্বামীর হাতে নির্যাতিত হয়েছেন ৪৯ শতাংশ নারী।
এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত নারীর সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ ৬৬ হাজার। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই রয়েছেন ৪ লাখের উপর। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গৃহ খাতে কর্মী নিতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সৌদি সরকারের একটি চুক্তি হয়।
এ চুক্তির আওতায় বিনা খরচে সৌদি আরব যেতে পারেন নারীরা। এসব নারীর বেতন ৮০০ রিয়াল বা ১৭০০০ টাকা। দুই বছরের জন্য এই চুক্তির আওতায় নারীরা সৌদি আরব যাচ্ছেন। এ চুক্তির অধীনে ৩ লাখের মতো নারী শ্রমিক সৌদি আরব গেছেন।
যেসব নারী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করার জন্য বিদেশে যান, তাদের বেশির ভাগের বয়স ২৫ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। অসচ্ছল বা স্বামী পরিত্যক্ত নারীরাই মূলত কাজ করার জন্য এসব দেশে যাচ্ছেন। যখন নারী শ্রমিকদের কথা আসে তখন তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও সামনে আসে।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এসব প্রবাসী নারীকর্মীর নিরাপত্তার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। নারীকর্মীদের বেশিরভাগই শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার। গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলেও তাদের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে দাসীর মতো ব্যবহার করা হচ্ছে।
এমন অনেক ঘটনার বিবরণ আমরা খবরের কাগজে দেখতে পেয়েছি। যে স্বপ্ন নিয়ে আত্মীয়স্বজন ছেড়ে প্রবাসে পাড়ি জমাচ্ছেন নারীরা, তা খুব কম সময়ের ব্যবধানেই বালির বাঁধের মতো ভেঙে যাচ্ছে। এ নারীদের অনেকেই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
২০২০ সালে করোনা মহামারির মধ্যে বিদেশ থেকে ফিরে এসেছেন মোট চার লাখ ২৫ হাজার ৬৯৭ জন কর্মী। এর মধ্যে ৫০ হাজার ৬১৯ জন নারী। আর তাদের ২২ হাজারই সৌদিফেরত। তাদেরও বেশির ভাগই নানা ধরনের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন।
ব্র্যাকের তথ্য মতে, ১৯৯১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১০ লাখ নারী বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। নির্যাতনে মানসিক ভারসাম্য হারানো ও পঙ্গু হওয়া নারীর সংখ্যা হাজারের বেশি। বাড়ছে লাশ হয়ে ফিরে আসার সংখ্যাও।
বেসরকারি সংস্থা ‘ব্র্যাক’ ও ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ’ (বিলস)-এর তথ্যানুযায়ী, গত পাঁচ বছরে পাঁচ শতাধিক নারী শ্রমিকের মরদেহ দেশে এসেছে। এর মধ্যে দুই শতাধিক মরদেহ এসেছে সৌদি আরব থেকে।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে একটি বড় ভূমিকা রেখেছে রেমিট্যান্স বা প্রবাস আয়। নারী কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উদাসীনতা কেন? ২০১৯ সালে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদনে নারীদের নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তনে যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি? সম্ভবত না। আর সে কারণেই নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসা নারী কর্মীর সংখ্যা শুধু বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গৃহকর্মী নিয়োগের কথা বলে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে যৌনকর্মী হিসেবে। তারা সেখানে গিয়ে কী কাজ করছেন, কেমন আছেন, তার দেখভালও সরকার করে না। বিদেশে নারী কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে দালালদের প্রতারণা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে সক্রিয় হতে হবে।
অন্যদিকে, দেশে ফেরা এসব অভিবাসী নারী শ্রমিকের অনেককেই পড়তে হয় নতুন মানসিক চাপে। সমাজ এমনকি পরিবারের সদস্যদের কাছেও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির শিকার হতে হয় তাদের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বামীরা তাদের তালাক পর্যন্ত দেন আর অবিবাহিত নারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সৃষ্টি হয় শঙ্কা ও জটিলতা। ফলে সার্বিকভাবে এই বিষয়গুলো কতটা ভয়ানক তা সংশ্লিষ্টদের আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত জরুরি বলেই প্রতীয়মান হয়।
তারা বলেন, বলার অপেক্ষা রাখে না, এর আগেও এমন বিষয় উঠে এসেছে যে, চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কিংবা নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসা নারীকর্মীর সংখ্যা কমছে। আমরা বলতে চাই, স্বচ্ছলতার আশায় বিদেশ গমন করে নির্যাতিত হয়ে ফিরে এলে তা কতটা ভয়ানক সেটা অনুধাবন করা অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের কর্তব্য হওয়া দরকার, বিদেশে কর্মরত নারী শ্রমিকের সুরক্ষা সংক্রান্ত সামগ্রিক বিষয় নিয়ে উদ্যোগী হওয়া।
আরও বলেন, সর্বোপরি, আমরা বলতে চাই, বাংলাদেশ জনসংখ্যাবহুল দেশ, ফলে জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করার বিষয়টি জরুরি। এ ক্ষেত্রে, নারীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে বিদেশে কর্মরত নারী শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২২
আপনার মতামত জানানঃ