প্রবল ক্ষমতার জেরে গত দুই দশকে একের পর এক বিভিন্ন দেশে আগ্রাসন চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ তালিকায় ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নাম রয়েছে। তবে ইতোমধ্যে অনেক দেশ থেকে সৈন্য ফিরিয়ে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তান থেকেও তারা পুরোপুরি ফিরে গেছে।
যে লক্ষ্য নিয়ে তারা আগ্রাসন চালিয়েছিল, তার সামান্যতম অংশও পূরণ হয়নি। বরং যে তালিবানকে শায়েস্তা করতে তারা এসেছিল এখন তাদের সাথে সমঝোতার চেষ্টা চালাচ্ছে। এর পেছনে অনেক কারণের সাথে দায়ী মার্কিন সেনাদের আত্মহত্যাও। যুদ্ধক্ষেত্রে বর্তমান থাকা বা ফেরত আসা সেনাদের মধ্যে আত্মহত্যার হার মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। এছাড়া বেড়েছে মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হওয়ার হারও।
বৃহস্পতিবার পেন্টাগনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে ১৫ শতাংশ বেড়েছে।
মার্কিন গণমাধ্যম ইউএসএ টুডে প্রতিরক্ষা বিভাগের সূত্রের বরাতে জানায়, ২০২০ সালে ৫৮০ জন মার্কিন সেনা আত্মহত্যা করেছেন। অপরদিকে ২০১৯ সালে আত্মহত্যা করা মার্কিন সেনার সংখ্যা ৫০৪।
আত্মহত্যাসংক্রান্ত ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, এর মধ্যে ৩৮৪ জন ছিলেন কর্মরত অবস্থায়, ৭৭ জন অতিরিক্ত বাহিনীর এবং বাকি ১১৯ জন জাতীয় সুরক্ষা বাহিনীর সেনা।
মার্কিন গণমাধ্যম জানায়, আত্মহত্যা করা অধিকাংশ সেনা ছিলেন তরুণ ও পুরুষ।
এর আগে ২০১৮ সালে ৫৪৩ মার্কিন সেনা আত্মহত্যা করেছিলেন।
ইউএসএ টুডে জানায়, আলাসকায় সেনাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতারোধে সেনাবাহিনী ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি খরচ করেছে।
প্রতিরক্ষা বিভাগের আত্মহত্যা প্রতিরোধ অফিসের পরিচালক ডা. কারিন অরভিস বলেন, আত্মহত্যা যুক্তরাষ্ট্রে ও সেনাবাহিনীর মধ্যে গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা।
দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন এই তথ্যকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে অভিহিত করেছেন।
যুদ্ধে যত সেনা নিহত হয়েছে, আত্মহত্যা করছে তার চেয়ে বেশি। ফলে সেনাদের এ ব্যক্তিগত ক্ষতি বড় ধরনের সামষ্টিক ক্ষতির মুখোমুখি ফেলে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে। বিষয়টি টের পেয়েই তারা বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের পাততাড়ি গুটাচ্ছেন যত দ্রুত সম্ভব।
২০২০ সালে ৫৮০ জন মার্কিন সেনা আত্মহত্যা করেছেন। অপরদিকে ২০১৯ সালে আত্মহত্যা করা মার্কিন সেনার সংখ্যা ৫০৪।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটসন ইনস্টিটিউটের প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনেও একই ধরনের কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গত ২০ বছর ধরে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে অনেক বেশি হারে। ৯/১১-পরবর্তী সময়ে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশের শুরু করা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা আফগানিস্তানে অভিযান চালায়। ২০০১ থেকে চালু করা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় থেকে এ পর্যন্ত মোট ৩০ হাজার ১৭৭ মার্কিন সেনা আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যার মাধ্যমে মরে যাওয়া সেনাদের মধ্যে যেমন দায়িত্বরত সেনারা আছে, তেমনি যুদ্ধফেরত সেনারাও আছে। অপরদিকে এসব যুদ্ধে মাত্র সাত হাজার ৫৭ জন মারা গেছেন।
এছাড়া মোট মার্কিন সেনাদের মধ্যকার ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পিটিএসডি মানসিক রোগে ভুগছে, সংখ্যায় যা পাঁচ লাখের ওপরে। মূলত, এ অবস্থা দেখেই সাবেক মার্কিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে কোনো উপায়ে মার্কিন সেনাদের ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম শুরু করেন।
দুই দশক ধরে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথিত যুদ্ধ চালিয়ে আসার পর যুক্তরাষ্ট্র এখন বুঝতে পারছে, এসব যুদ্ধ ছিল আসলে লক্ষ্যভ্রষ্ট এক অনর্থক কর্মকাণ্ড। বিশেষ করে আফগানিস্তান ও ইরাকে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পেন্টাগনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশেষ করে পুরনো সেনা সদস্যদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। প্রত্যাহার করে আনার পরও অনেকে আত্মহত্যা করেছে। এ পরিস্থিতিতে পেন্টাগন এই আত্মহত্যার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে জোর প্রচেষ্টা শুরু করেছে। মার্কিন সেনা সদস্যদের মধ্যে আত্মহত্যার সামাজিক প্রভাবের বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে সেনা সদস্যদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও নজিরবিহীনভাবে আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, তারা নিজ চোখের সামনে এত বেশি মৃত্যু দেখেছে যে, মৃত্যুকে তাদের কাছে আর অস্বাভাবিক কিছু বলে মনে হয় না। বরং তাদের মনে এমন ধারণা জন্মে গিয়েছে যে, মৃত্যুই পারে যেকোনো সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান বয়ে আনতে। আর যেহেতু সামরিক বাহিনীতে কাজ করার সুবাদে তাদের মনোবল গড়পড়তা মার্কিন নাগরিকদের তুলনায় অনেক বেশি দৃঢ়, তাই আত্মহত্যার সিদ্ধান্তের বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে তাদের খুব বেশি বেগ পেতে হয় না।
চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, একজন মানুষের মস্তিষ্কের পক্ষে সর্বোচ্চ একটি বা দুটি নিকটবর্তী বিস্ফোরণের চাপ সহ্য করা সম্ভব। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে যারা যুদ্ধ করতে গিয়েছিল, তারা প্রায় সকলেই এর অনেক বেশি নিকটবর্তী বিস্ফোরণের সাক্ষী হয়েছে, যা তাদের মস্তিষ্ককে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বারবার বিস্ফোরণের চাপ সহ্য করায় তাদের মস্তিষ্ক হয়তো স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, যে কারণে তারা ভালো-মন্দ চিন্তা না করে আত্মহত্যা করে ফেলছে।
কেবল যে যুদ্ধ ফেরত সেনারাই এই পথ বেছে নিচ্ছে তা নয়। সেনাবাহিনীর মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন যে আত্মহত্যাকারীদের এক-তৃতীয়াংশকে কখনো কোনো যুদ্ধেই পাঠানো হয়নি। এরপরেও কেন আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে সেটি একটি বিরাট প্রশ্ন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৬
আপনার মতামত জানানঃ