আপনি যদি মনে করেন, কোভিড-১৯ শুধুই একটা শ্বাসতন্ত্রের রোগ, তাহলে ভুল করছেন। যত দিন যাচ্ছে ততই আরো বেশি করে স্পষ্ট হচ্ছে যে করোনাভাইরাস মানুষের মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি করছে।
‘নোভেল করোনাভাইরাস’ নিঃসন্দেহে এ শতাব্দীতে গোটা পৃথিবীর মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম। সামান্য কয়েক ন্যানোমিটারের ক্ষুদ্র এক মাইক্রোঅর্গানিজমের কাছে আজ গোটা পৃথিবী অসহায়। খালি চোখে দেখা যায় না অথচ কোনো এক অদৃশ্য শক্তি রূপেই গোটা পৃথিবীকে সে অচল করে দিচ্ছে এবং বিশ্বের প্রায় সব দেশ এক হয়েও রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে এ ক্ষুদ্র অণুজীবটির কাছে।
করোনাভাইরাস ১৮ মাসের বেশি সময় ধরে বিশ্বব্যাপী মানুষকে হুমকির মধ্যে রেখেছে। এটির সংক্রমণের সময় এমনকি পরেও স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নানা ধরনের শারীরিক জটিলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আক্রান্ত মানুষ।
মস্তিষ্কসহ পুরো শরীরে করোনার ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে গবেষণা জারি রেখেছেন বিজ্ঞানীরা। বার্ধক্যের মতো জৈবিক প্রক্রিয়ায় ভাইরাসটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে এরই মধ্যে বলা হয়েছে।
টেক্সাস এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক জেসিকা বারনার্ড বলেন, ‘আমার আগের গবেষণা বার্ধক্যের সঙ্গে স্বাভাবিক মস্তিষ্ক পরিবর্তন ঘিরে ছিল। এ পরিবর্তন মধ্য বয়সি ও তার চেয়ে বেশি বয়সি ব্যক্তিদের চিন্তা ও চলাফেরার ক্ষমতায় পরিবর্তন আনে।’
‘তবে সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণায় জানা গেছে, করোনায় সংক্রমিত হওয়ার পর শরীর ও মস্তিষ্কের ওপর এর প্রভাব কয়েক মাস বা তারও বেশি সময় ধরে থাকতে পারে।’
‘এটি জানার পর আমার গবেষণা দল বার্ধক্যের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় করোনা কীভাবে প্রভাব ফেলে, তা অনুসন্ধানে আগ্রহী হয়।’
সায়েন্স এলার্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের আগস্টে করোনা হওয়া ব্যক্তিদের মস্তিষ্কে পরিবর্তন নিয়ে প্রাথমিক তবে বড় আকারের গবেষণা করেন বিজ্ঞানীরা। ওই গবেষণা স্নায়ুবিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে।
গবেষণাটিতে ইউকে বায়োব্যাংক নামের হাতের নাগালে থাকা ডেটাবেজের ওপর নির্ভর করেন বিজ্ঞানীরা। ইউকে বায়োব্যাংকে ২০১৪ সালে ৪৫ হাজারের বেশি মানুষের ব্রেন ইমেজিং ডেটা ছিল। এর অর্থ করোনা মহামারির আগে ওই সব ব্যক্তির সবার বেইজলাইন ডেটা ও ব্রেন ইমেজিং ইউকে বায়োব্যাংকে রয়েছে।
ওই সব ব্যক্তির ব্রেন ইমেজিং ডেটা বিশ্লেষণ করেন গবেষণা দলটি। এরপর ওই ব্যক্তিদের মধ্যে যারা করোনায় আক্রান্ত হন, তাদের ব্রেন স্ক্যান করা হয়।
করোনায় আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তি ও আক্রান্ত না হওয়া ব্যক্তিদের আলাদা করেন গবেষকরা। দুই গ্রুপের বয়স, লিঙ্গ, বেইজলাইন টেস্ট ডেটা ও অবস্থানের ওপর সতর্ক নজর রাখেন তারা। একই সঙ্গে অংশগ্রহণকারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের মতো রোগের অন্যান্য ঝুঁকির ওপরও লক্ষ রাখা হয়।
গবেষণায় দুই গ্রুপের মানুষের মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটারে পার্থক্য দেখতে পান বিজ্ঞানীরা। বিশেষ করে মস্তিষ্কে ফ্রন্টাল ও টেমপোরাল লোবস নামে পরিচিত অংশে করোনা আক্রান্ত গ্রুপের গ্রে ম্যাটারের ঘনত্ব কম ধরা পড়ে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণত গ্রে ম্যাটারের ঘনত্বে পরিবর্তন আসে। তবে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এ পরিবর্তন বেশি ছিল।
গবেষণায় আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় উঠে আসে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বেশি অসুস্থ ব্যক্তি ও ভাইরাসটির সংক্রমণ শরীরে কম হওয়া ব্যক্তির মস্তিষ্কে পরিবর্তন একই ছিল। অর্থাৎ করোনার ভয়াবহ ও মৃদু জটিলতায় ভোগা ব্যক্তিদের মস্তিষ্কে গ্রে ম্যাটারের ঘনত্ব একই পরিমাণে কমে যায়।
এছাড়া মস্তিষ্কের শিরা ও ধমনীর ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে এই ভাইরাস। এ থেকে রক্তবাহ সংকোচন হলে রক্ত চলাচলে সমস্যা হচ্ছে, অক্সিজেনের সরবরাহ কমে যাচ্ছে। সে জন্য দ্রুত প্রভাব পড়ছে মস্তিষ্কে। কোভিডের সঙ্গে স্ট্রোকে তাই প্যারালাইসিসের পরিমাণও অনেক বেশি।
গবেষকরা আরও জানতে পারেন, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা তথ্য প্রক্রিয়াকরণে বেশি সময় নেন, যা ভাইরাসটিতে আক্রান্ত না হওয়া ব্যক্তিরা নেন না।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬০৫
আপনার মতামত জানানঃ