প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে পৃথিবী। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে জলবায়ুর কুপ্রভাব বিশ্বে মরুকরণ একটি অন্যতম সমস্যা। বিশ্বের জলাভূমির প্রায় ৭০% ইতিমধ্যেই হয়ে পড়েছে মরুকবলিত। এর পরিমাণ পৃথিবীর মোট ভূমির চার ভাগের এক ভাগ।
এভাবেই বর্তমানে তীব্র খরার কারণে রকপোর্ট লেকের পানি ২৯ শতাংশ শুকিয়ে গেছে, ফলে ৬৪ বছরে প্রথমবারের মতো একটি শহর ভেসে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহ’র রকপোর্ট রিজারভয়েরে তীব্র খরার কারণে বহু বছর ধরে বিস্মৃত পানির নিচে তলিয়ে যাওয়া একটি শহরের ভিত্তিপ্রস্তর ভেসে উঠেছে। ১৯৫৭ সালে ফেডারেল সরকার ওয়ানশিপ বাঁধ নির্মাণের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে রকপোর্ট শহরটি পরিত্যক্ত ছিল।
সে সময় ওই এলাকায় ২৭টি পরিবারের ২০০ জন মানুষের বাস ছিল। রকপোর্ট স্টেট পার্ক এলাকায় শ্বেতাঙ্গ সেটেলাররা আসে ১৮৬০ সালের দিকে। বর্তমানে তীব্র খরার কারণে রকপোর্ট লেকের পানি ২৯ শতাংশ শুকিয়ে গেছে, ফলে ৬৪ বছরে প্রথমবারের মতো শহরটি ভেসে উঠেছে।
ড্রোন টেস্ট পাইলট ডেভন ডিউই সম্প্রতি সেখানকার ছবি তুলে টুইটারে শেয়ার করেছেন। ছবিগুলোতে ভেসে ওঠা জনপদের রাস্তাঘাট ও ঘর-বাড়ির মতো দেখতে স্থাপনারর অবশিষ্টাংশ দেখা যাচ্ছে।
পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া সত্ত্বেও, রকপোর্ট স্টেট পার্কটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে যদিও নৌকা ভ্রমণ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। জলাধারটি দেখতে এলে দর্শনার্থীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন স্থানীয় কর্মকর্তারা
স্থানীয় সরকার ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, ইউটাহ-এর প্রায় ৮৮.১ শতাংশ অঞ্চলে বর্তমানে চরম খরা দেখা দিয়েছে।
এদিকে, আজকের দুনিয়ার পরিবেশের বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে মরুকরণ অন্যতম। জাতিসংঘ বলেছে, পৃথিবীর প্রায় দেড়শ কোটি মানুষ বেঁচে থাকার জন্য ক্ষয়িষ্ণু ভূমির উপর নির্ভরশীল। আর পৃথিবীর অতি দরিদ্রদের প্রায় ৪৩ ভাগই বাস করে ক্ষয়ে যাওয়া এলাকায়, যারা মারাত্মক নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করছে। এই ভূমিক্ষয় জলবায়ু পরিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করেছে, যা শুধু আমাদের বেঁচে থাকার জন্যই বিপদের কারণ নয়; বরং এটি আমাদের শান্তি এবং স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকিস্বরূপ।
জাতিসংঘের এক গবেষণা বলছে ২০ বছর পর মানবজাতির যাবতীয় চাহিদা অতিতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। সে সময়ে বর্তমানের প্রায় ৫০% বেশি খাদ্যের প্রয়োজন হবে। জাতিসংঘ আশঙ্খা করছে তখনকার চাহিদামতো প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অন্যান্য উপাদানের ঘাটতি দেখা দিয়ে সেটা সংকট সৃষ্টি করতে পারে। সেই সংকট গতি নিয়ে চলে যেতে পারে সংঘর্ষের দিকে। আর এই সংকটের একমাত্র কারন হবে মরুকরণ ও খরা।
মরুকরণ যেমনিভাবে বিশ্বব্যাপী মাথা ব্যাথার কারণ তেমনি আমাদেরও উদ্বেগের যথেষ্ঠ কারন রয়েছে।
দুটি গবেষণার সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে গত ৫৭ বছরে ১৫৮টি নদী শুকিয়ে গেছে। ১৯৬৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশে নদ-নদীর সংখ্যা কত কমল, সেই সংক্রান্ত একটি সমীক্ষা ২০১০ সালে প্রকাশ করে বাংলাদেশ দুর্যোগ ফোরাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের একদল গবেষক তালিকা তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাতে বলা হয়, দেশের ১১৫টি নদ-নদী শুকিয়ে মৃতপ্রায়।
অন্য দিকে নদী, পানি–প্রকৃতি নিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন উত্তরণের সমীক্ষা অনুযায়ী, গত ২০ বছরে (২০০০ থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত) দেশে ৪৩টি নদী শুকিয়ে গেছে। উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ও নদীতে নানা অবকাঠামো নির্মাণ ও দখলের কারণে নদীর মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না।
মরুকরণ এতোদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না হলেও এখন এটি পরিবেশ বিজ্ঞানীদের যথেষ্ঠ ভাবিয়ে তুলেছে। সম্প্রতি আমাদের দেশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আম্পান, ফণী, সিডর, আইলা, নার্গিসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ এই ভাবনাকে আরো প্রবল করে তুলেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামল দেশটি হয়তো একদিন হারিয়ে যেতে পারে মরুভূমির ধূসর বালির গহ্বরে। বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থা বিশ্লেষন করে বিশ্লেষকরা এটাই আশঙ্খা করছেন। তারা বলেছেন মরুকরণের প্রধান দুটি বিষয় হচ্ছে একটি বিস্তৃত এলাকা ছেড়ে যদি সেখানকার মাটি অনুর্বর হতে থাকে এবং যদি নদী-নালা, খাল বিল শুকিয়ে যেতে থাকে ও বৃষ্টির অভাব ঘটে। বিগত কয়েক দশক ধরে এ লক্ষণগুলো বেশিভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে বাংলাদেশে।
এ পরিস্থিতিতে কৃষিজমি সংরক্ষণ, কৃষিকাজে জৈবসার ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিতকরণে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচারণা, অপরিকল্পিত নগরায়ন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা, নদীর পাণি প্রবাহে যথাযথ উদ্যোগ, খাল-বিল ও জলাভূমি সমূহ সংরক্ষণে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৭১৭
আপনার মতামত জানানঃ