করোনা মহামারিতে দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নানা কারণে ঝরে পড়ছে বহু শিক্ষার্থী। এদের একটি বড় অংশ শিকার হয়েছে বাল্যবিয়ের। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ছাত্রীরা বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এক বিদ্যালয়েই শতাধিক ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে এমন তথ্যও আছে। আবার একই গ্রামে একাধিক বাল্যবিয়ের ঘটনাও আছে। উপকূলীয় ও হাওড়াঞ্চলে অনেক ছাত্রীর মাথায় সংসারের বোঝা চেপেছে। অভাব-অনটনের কারণে বাবা-মা অনেকটা গোপনেই অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছেন সন্তানদের। এই ছাত্রীদের আর ক্লাসে ফেরার সম্ভাবনা নেই।
এমনই একজন নিমি আক্তার। সে কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার নিশ্চিন্তপুর এলাকার বাসিন্দা। স্থানীয় আসলাম খান উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিল নিমি। এক ভাই ও দুই বোনের মধ্যে নিমি সবার ছোট। তার বাবা কুমিল্লার কোটবাড়ির একজন ব্যবসায়ী।
নিমি ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষের এসএসসির পরীক্ষার্থী ছিল। পরীক্ষা দেওয়ার খুব ইচ্ছে থাকলেও গত জুন মাসে করোনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবার তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। পড়ালেখা বন্ধ করে কেন বিয়ে দেওয়া হলো, জানাতে চাইলে তার ভাই রাকিব জানান, বোনকে দিয়ে তারা চাকরি করাবে না, তাই বিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া অন্য কোনও সমস্যা নেই।
সুবরাতি শাহজাদী মোমোরিয়াল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, নিমি নিশ্চিন্তপুর আসলাম খান উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। ওই স্কুলের পরীক্ষার্থীরা আমাদের বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন করেন। করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় গত জুন মাসে নিমিকে বিয়ে দিয়ে দেয় তার পরিবার। বিয়ের সংবাদ শুনে তার পরিবারের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ ও অনুরোধ করেও বিয়ে ঠেকানো যায়নি।
তিনি আরও বলেন, শুধু নিমি নয় তার বিদ্যালয়ের নবম ও দশম শ্রেণির আরও একাধিক ছাত্রীর করোনাকালে বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ে হয়ে যাওয়া ছাত্রীরা আর স্কুলে ফিরছেন না। এদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালুর ১০ দিন অতিবাহিত হলেও ৩০ শতাংশ ছাত্রী এখনও ক্লাসে অনুপস্থিত বলে জানান তিনি। এছাড়া গড়ে ৩৫ ভাগ ছাত্রছাত্রী অনুপস্থিত বলে দাবি তার।
করোনাকালে দীর্ঘ ছুটির পর ফের আনুষ্ঠানিক পাঠদান শুরু হলেও কুমিল্লা জেলার ৬০৫টি সরকারি ও আধা সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিমির মতো বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী আর বিদ্যালয়ে ফেরেনি। করোনার কারণে শহরাঞ্চলের অনেক পরিবার গ্রামে চলে গেছে। সামর্থ্য না থাকায় সেখানেও কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্তি হতে পারেনি। আবার অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে, ছাত্ররা প্রবাসে কিংবা কর্মজীবনে ঢুকে পড়েছেন।
একাধিক স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিদ্যালয় খোলার মাত্র কয়েকদিন হলেও বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আলামত তারা দেখতে পাচ্ছেন। অনেক শিক্ষার্থীর অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে না আসা এবং শিক্ষকদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ না রাখা এবং এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ না করা বিষয়টিকে স্পষ্ট করেছে।
কুমিল্লা আদর্শ সদর রাজাপুর ফয়েজুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া ৬৪ জন ছাত্রীর মধ্যে করোনার বন্ধের পর গত ১০ দিনে গড়ে উপস্থিতি ৫২। বাকি ১২ জন ছাত্রী ক্লাসে অনুপস্থিত। একই অবস্থা নবম শ্রেণিতেও। নবম শ্রেণির ৫৩ জন ছাত্রীর মধ্যে গড়ে উপস্থিত ৪২ জন। ধারাবাহিকভাবে অনুপস্থিত ১১ জন ছাত্রী। উপস্থিত ছাত্রীরাই কেবল ক্লাস অ্যাসাইমেন্ট জমা দিয়েছেন বলে জানান প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম।
তিনি বলেন, করোনার বন্ধের পর স্কুলের নবম ও দশম শ্রেণির ছাত্রীদের মধ্যে গড় উপস্থিতি ৭০ শতাংশ। অনুপস্থিত ছাত্রীদের অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে পরিবার থেকে জানানো হয়, তারা দেশে চলে গেছেন। সত্য গোপন করলেও আমরা খবর নিয়ে দেখেছি অনুপস্থিত অধিকাংশ ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে।
অন্যদিকে কুমিল্লা শহরতলীর সুবরাতি শাহজাদী মোমোরিয়াল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ১৮৯ জন। তাদের মধ্যে গত দশ দিনে গড়ে উপস্থিতি ১৩০ থেকে ১৪০। বাকি প্রায় ৪৯ জন শিক্ষার্থী ধারাবাহিক অনুপস্থিত রয়েছেন। তারা অ্যাসাইনমেন্টও জমা দেয়নি।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, স্কুলের প্রতিটি ক্লাসে এখনও গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত। স্কুল থেকে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে নবম ও দশম শ্রেণির অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধিকাংশ ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে।
সদর দক্ষিণ উপজেলার কমলপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক মো. মমিনুল ইসলাম জানান, করোনার দীর্ঘ বন্ধ কাটিয়ে পুনরায় চালুর পর তার বিদ্যালয়ে নবম-দশম শ্রেণির প্রায় ৩৫ ভাগ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত এখনও। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছাত্রী। তার ধারণা করোনার দীর্ঘ বন্ধের পর ক্লাসে অনুপস্থিত এই শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়েছেন। আবার অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। তারপরও তারা অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
কুমিল্লা শহরতলীর আরেক স্কুল আলেকজান মেমোরিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল মান্নান জানান, তার বিদ্যালয়ের নবম-দশম এবং এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৩০ ভাগ শিক্ষার্থী ক্লাসে এখনও অনুপস্থিত। শিক্ষকদের বিভিন্ন জনের মুখ থেকে শুনছেন অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। তারা আরও স্কুলে ফিরছেন না। তবে এই ধরনের কোনও তালিকা করা হয়নি।
এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আবদুল মজিদ জানান, কুমিল্লা জেলায় ৬০৫টি সরকারি ও আধা সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। করোনায় দীর্ঘ বন্ধের পর উপজেলা এবং জেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা বিভিন্ন উচ্চবিদ্যালয় পরিদর্শন করেছে। পরিদর্শনে দেখা গেছে বিদ্যালয়ে গড়ে ৭০-৭৫ ভাগ শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়েছেন। প্রতিদিনই স্ব স্ব বিদ্যালয়কে তাদের প্রত্যেক ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি রেকর্ড করে অনলাইনের মাধ্যমে কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
শুধু কুমিল্লা নয়, এমন পরিস্থিতি গোটা দেশেই। করোনাকালে রাজশাহীতেও যেন বাল্যবিয়ের মহামারি হয়েছে। গত দেড় বছরে এ অঞ্চলে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে পাঁচ শতাধিক ছাত্রী। পড়াশোনার চাপ না থাকায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী অলস সময় কাটিয়েছে।
রাজশাহী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (মাধ্যমিক) নাসির উদ্দিন বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অসচেতন অভিভাবকরা অত্যন্ত গোপনে তাদের সন্তানদের বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাল্যবিয়ে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।
আমরা ধারণা করছি, এসময় রাজশাহীতে পাঁচ শতাধিক বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। এর পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, বাল্যবিয়ের সঠিক পরিসংখ্যান জানানোর জন্য আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের চিঠি দিয়েছি। আশা করছি অল্প সময়ের মধ্যে এটি জানা যাবে।
এদিকে, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের সারডোব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফজলে রহমান বলেন, আমার বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ২২৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬৩জন ছাত্রী। প্রাথমিক তথ্য মতে বিয়ে হয়েছে ১৮জন ছাত্রীর। এর মধ্যে বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির চারজন ছাত্রীর মধ্যে জেসমিন ছাড়া বাকি তিনজনেরই বাল্যবিয়ে হয়ে গেছে। ৯ম শ্রেণিতে ৯ জনের মধ্যে নার্গিস ছাড়া ৮ জনের বিয়ে হয়েছে। এছাড়া ষষ্ঠ শ্রেণির একজন, সপ্তম শ্রেণির দুজন, অষ্টম শ্রেণির চারজনের বাল্যবিয়ে দিয়ে দিয়েছে পরিবার।
বেসরকারি সংস্থা প্লান বাংলাদেশের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত কুড়িগ্রামে বিয়ে হয়েছে ২২ হাজার ৩৯১টি। এর মধ্যে নিবন্ধিত বিয়ে ১৯ হাজার ২২১টি এবং অনিবন্ধিত বিয়ে ৩ হাজার ১৭০টি। জেলার ৯ উপজেলায় বাল্যবিয়ে সংগঠিত হয়েছে ৩ হাজার ১৯টি। এরমধ্যে কুড়িগ্রাম সদর-৭৩০টি, রাজারহাট-৭৪টি, উলিপুর-২৬১টি, চিলমারী-১৪৬টি, রৌমারী-৮৮টি, রাজিবপুর-৫০টি, নাগেশ্বরী-১১৪০টি, ফুলবাড়ি-২৯১টি, ভূরুঙ্গামারীতে-২৩৯টি বাল্যবিয়ে হয়েছে। এছাড়া বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ হয়েছে এক হাজার ১৩৬টি।
মাদ্রাসায় পরিস্থিতি আরও জটিল। সূত্র মতে, কমলনগরের পাটোয়ারিরহাট মহিলা দাখিল মাদ্রাসার শতাধিক ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। এসব কারণে লক্ষ্মীপুরের উপকূলে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কমলনগর উপজেলার পাটোয়ারিরহাট মহিলা দাখিল মাদ্রাসার সুপার মাওলানা মুহাম্মদ আবুল খায়ের বলেন, গত দেড় বছরে তার মাদ্রাসার পঞ্চম শ্রেণি থেকে ১০ শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় শতাধিক ছাত্রীর গোপনে বাল্যবিয়ে হয়ে গেছে। কমলনগর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাল্যবিয়ে ও যারা বিদেশ চলে গেছে তাদের আর ফেরানো সম্ভব হবে না।
এছাড়া টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার ২৭টির মধ্যে ১২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আড়াই শতাধিক ছাত্রীর বাল্যবিয়ের খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ৯টি দাখিল মাদ্রাসার একটিতেই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ১৬ ছাত্রী।
পার্বত্য জনপদ খাগড়াছড়িতে ঝরে পড়েছে অনেক শিক্ষার্থী। করোনাকালে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় তাদের এই পরিণতি। কেবল দীঘিনালার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের অন্তত ৩৪ ছাত্রী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে।
এর মধ্যে মেরুং উচ্চ বিদ্যালয়ে ২০ জন, দীঘিনালা মডেল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ জন, অনাথ আশ্রম আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ের ১ জন ও হাচিনসনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫ জন ছাত্রী রয়েছে। তাদের সবারই এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬১৯
আপনার মতামত জানানঃ