নগর সভ্যতার ডামাডোলে গোটা বিশ্ব এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যেখানে প্রাণ ধারণের জন্য ন্যূনতম বিশুদ্ধ আলো, বাতাস ও পানির মতো প্রকৃতির অফুরান দানগুলো অবশিষ্ট থাকার সুযোগ নেই। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে নানা বিরূপ প্রভাবসহ মানবসৃষ্ট পরিবেশ দূষণের কবলে পড়ে ক্রমেই হুমকির মুখে এগিয়ে চলছে জনজীবন। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দ্রুত শিল্পায়নের এই অশুভ প্রতিযোগিতার করাল গ্রাসে পড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে, লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে দূষণ। প্রতি বছর বিশ্বে বায়ুদূষণের কারণে অন্তত ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়৷
বায়ুদূষণ সব দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। তবে এটি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় চরম ঝুঁকি তৈরি করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য দেয়া হয়েছে৷
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে, প্রতিবছর শুধু বায়ুদূষণে বিশ্বে ৭০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু হয়। এ সমস্যার সমাধানে বিশ্বজুড়ে বায়ুর মান উন্নত করতে এয়ার কোয়ালিটি গাইডলাইনস (একিউজিএস) আরও জোরদার করেছে সংস্থাটি। খবর আল–জাজিরার।
নতুন একিউজিএস প্রকাশ করে বুধবার বৈশ্বিক সংস্থাটি বলেছে, তীব্র বায়ুদূষণ প্রতিরোধ করতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। কেননা বিশ্বজুড়ে বায়ুর মানের প্রতিটি সূচক নিম্নমুখী রয়েছে। এটা জনস্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। অস্বাস্থ্যকর খাবার ও ধূমপানের চেয়েও বেশি স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি করেছে।
বায়ুর মানের নতুন গাইডলাইন বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে লাখো মানুষকে সুরক্ষা দেবে বলে মনে করছে ডব্লিউএইচও। একই সঙ্গে এটি সরকারগুলোকে বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে লড়তে মানবিষয়ক আইনগত সীমা নির্ধারণে সহায়ক হবে। স্বাস্থ্যঝুঁকি কমিয়ে আনবে। লাখো মানুষের জীবন রক্ষা করবে।
সর্বশেষ ২০০৫ সালে একিউজিএস প্রকাশ করেছিল ডব্লিউএইচও। সংস্থাটি বলছে, ২০০৫ সালের পর থেকে ১৬ বছর ধরে সংগ্রহ করা তথ্য–উপাত্ত এটাই বলছে যে বায়ুদূষণ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এটা কোনো নির্দিষ্ট দেশ কিংবা অঞ্চলভেদে নয়, বরং বিশ্বজুড়ে।
নতুন একিউজিএসে নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড, সালফার ডাই–অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইডসহ ছয় ধরনের দূষণ থেকে বায়ুমান উন্নত করার সুপারিশ করা হয়েছে। আগামী অক্টোবরে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে বসছে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বৈশ্বিক সম্মেলন কপ–২৬। এর আগে বায়ুদূষণ নিয়ে নতুন এই গাইডলাইন প্রকাশ করল ডব্লিউএইচও।
ডব্লিউএইচও’র নির্দেশনা অনুযায়ী বার্ষিক গড় পিএম ২ দশমিক ৫ এর মাত্রা প্রতি কিউবিক মিটারে ১০ মাইক্রোগ্রাম থেকে ৫ মাইক্রোগ্রাম করা হয়েছে। পিএম ১০ এর মাত্রা করা হয়েছে ১৫ মাইক্রোগ্রাম। ডব্লিউএইচও’র নির্দেশনা মানলে বায়ুদূষণজনিত মৃত্যুহার ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো যেতে পারে বলে মনে করেন সংস্থাটির মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম। কার্বন নিঃসরণ কমানো’সহ অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তনকে গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানান সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি।
ডব্লিউএইচও’র মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে তৈরি হচ্ছে মারত্মক বায়ুদূষণ। এর ফলে ফুসফুস হৃদযন্ত্র ও শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বস্তুকণা, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডসহ অন্যান্য দূষণ তৈরিকারী উপাদানের উপস্থিতি কমাতে হবে। সেকারণেই বায়ুর মান নিয়ে এই নতুন নির্দেশনা।
তীব্র বায়ুদূষণ প্রতিরোধ করতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। কেননা বিশ্বজুড়ে বায়ুর মানের প্রতিটি সূচক নিম্নমুখী রয়েছে। এটা জনস্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। অস্বাস্থ্যকর খাবার ও ধূমপানের চেয়েও বেশি স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি করেছে।
সংস্থাটির মতে, বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি বায়ুদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম পরিবেশগত হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে ডব্লিউএইচওর প্রধান তেদ্রোস আধানম গেব্রেয়াসুস বলেন, ‘বায়ুদূষণ সব দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। তবে এটি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় চরম ঝুঁকি তৈরি করেছে।’
এক সংবাদ সম্মেলনে ডব্লিউএইচও’র মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গ্যাব্রিয়েসুস বলেন, ‘বায়ু দূষণের ফলে প্রতি বছর অন্তত ৭০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু হচ্ছে। গবেষকেরা দেখিয়েছেন, এমনকি কম মাত্রায়ও দূষিত বায়ুও মানুষের শরীরের সব অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে মায়ের গর্ভে থাকা সন্তান এতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়।’
এর আগে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পরিমাপকারী সংস্থা আইকিউএয়ারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের দিক থেকে গত তিন বছরের মতো এবারও বিশ্বের শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। রাজধানী ঢাকাও বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে বরাবরের মতোই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।
আইকিউএয়ার জানিয়েছে, গত বছর সামগ্রিক বায়ু মান বিবেচনায় বাংলাদেশের বায়ুতে প্রাণঘাতী পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম-২.৫ এর উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটারে ছিল ৭৭ দশমিক ১ শতাংশ; যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া সীমার চেয়ে সাতগুন বেশি। দূষিত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের পরে রয়েছে যথাক্রমে-পাকিস্তান, ভারত, মঙ্গোলিয়া ও আফগানিস্তান।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার-এর গতবারের প্রতিবেদনেও বায়ুদূষণে বাংলাদেশ শীর্ষে ছিল, দূষিত রাজধানীতে ঢাকাও ছিল দ্বিতীয়তে। ২০১৯ সালে বিশ্বের ৯৮টি দেশের সার্বক্ষণিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছিল। বাংলাদেশের পর শীর্ষ তালিকায় থাকা অন্য দেশগুলো হলো পাকিস্তান, মঙ্গোলিয়া, আফগানিস্তান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, বাহরাইন, নেপাল, উজবেকিস্তান ও ইরাক।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, দেশে বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর প্রাণ হারাচ্ছে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষ। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বায়ুদূষণজনিত বার্ষিক মৃতের গড় সংখ্যা ৪৬ হাজার। অন্যদিকে জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) তথ্য বলছে, বিশ্বে ৩০ কোটি শিশু দূষিত বায়ু পরিবেষ্টিত এলাকায় বাস করে। এর মধ্যে ২২ কোটিই দক্ষিণ এশিয়ার বাসিন্দা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরবাসীর কাছে যানজটের পাশাপাশি আরেক যন্ত্রণার নাম বায়ুদূষণ। মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কবলে নগরজীবন বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে। বাড়িয়ে তুলছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু, বৃদ্ধ ও শ্বাসতন্ত্রের রোগীরা।
প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণে ফুসফুসের অক্সিজেন গ্রহণক্ষমতা কমে শ্বাসকষ্ট ক্রমাগত বাড়ে বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, প্রথমে শ্বাসনালি ও চোখে সমস্যা তৈরি করে। ফলে অ্যাজমা ও নিউমোনিয়ার রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে এ দূষিত বায়ু গ্রহণ ব্রঙ্কাইটিস থেকে ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে বলে উল্লেখ করেন। এদিকে বায়ুদূষণের কারণে ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বেশি দেখা দেয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়ে চললেও কর্তৃপক্ষ কার্যত কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না এমন অভিযোগ রয়েছে পরিবেশবিদদের। ঢাকার উন্নয়ন প্রকল্পকে ঘিরে সকাল-বিকাল পানি ছিটানো হলেও আশানুরূপ ফল দৃশ্যমান নয়। এ অবস্থায় সিটি করপোরেশনের পানি ছিটানোর কাজে সার্বক্ষণিক তদারক এবং বাতাসের মান স্বাভাবিক ও জীবনযাত্রায় স্বস্তি ফেরাতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। দূষণের মাত্রা যেভাবে বেড়েছে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গাড়ির কালো ধোঁয়া কমানো ও অপরিকল্পিত নির্মাণকাজের লাগাম টেনে ধরা প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, পরিবেশ রক্ষা করতে হলে মোটাদাগে যানবাহন, নির্মাণ শিল্প ও কল-কারাখানার দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এর মধ্যে বায়ুদূষণকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করতে হবে। সামগ্রিকভাবে সারা দেশকে দূষণের জন্য বিবেচনা করা হলেও রাজধানীর দূষণ এ সূচককে বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন তারা। বর্তমান সময়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দূষণকে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আলোকে ঢাকাসহ সারা দেশের বায়ুমান নিয়ন্ত্রণ করার পরামর্শ দেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১২
আপনার মতামত জানানঃ