প্রেমিকার ধর্মীয় পরিচয় হিন্দু, প্রেমিক মুসলিম। এতেই চটে যায় ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হিন্দু জাগরণ মঞ্চের সদস্যরা। সকলের সামনে প্রেমিকাকে দিয়ে জোর করে জুতো পেটা করা হয় ওই মুসলিম প্রেমিককে। এখানেই শেষ নয়। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দাজার পত্রিকার তথ্য বলছে, ওই প্রেমিককে কান ধরিয়ে উঠবসও করানো হয় রাস্তার ধারে। ঘটনা ভারতের উত্তরপ্রদেশের। এ নিয়ে পুলিশে অভিযোগ করেছেন ওই তরুণী।
পুলিশের কাছে ওই তরুণী অভিযোগ করেন, একটি বাজারের কাছে গাছের নিচে বসেছিলেন তারা। প্রথমে তাদের বসে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কাছের এক দোকানদার। এরপর ঘটনাস্থলে আসে হিন্দু জাগরণ মঞ্চের সদস্যরা। প্রথমে এসেই তাদের নাম জিজ্ঞাসা করে তারা। নাম বলার পরই স্পষ্ট হয় ধর্ম পরিচয়। তখনই শুরু হয় অত্যাচার।
ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, ওই যুগলকে আলাদা করে প্রথমে যুবককে মারধর করেন মঞ্চের কর্মীরা। তারপর তরুণীকে আদেশ দেন— তিনি যেন নিজের জুতা খুলে ওই যুবককে আঘাত করেন। জাগরণ মঞ্চের ক্ষুব্ধ কর্মীদের মারধর থেকে প্রেমিককে বাঁচাতে সেই আদেশ মেনে নিয়ে জুতা দিয়ে প্রেমিকের গালে আঘাত করেন ওই তরুণী।
কিন্তু যথেষ্ট জোরে না হওয়ায় ওই তরুণীকে ফের আঘাত করতে বলা হয়। ৫৬ সেকেন্ডের সেই ভিডিওচিত্রে তরুণীর উদ্দেশ্যে মঞ্চের এক কর্মীকে বলতে শোনা যায়, ‘এটা কিছু হলো! আরও জোরে মারো তাকে।’
তাদের আদেশ মেনে আর একটু জোরে প্রেমিককে ফের আঘাত করেন ওই তরুণী।
তারপর ওই কর্মী বলেন, ‘এখানে আমরা যারা আছি, সবাই তোমার ভাই। আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি, তোমার ভয়ের কোনো কারণ নেই। শরীরের সব শক্তি দিয়ে তাকে আঘাত করো।’
একই সময়ে অপর এক কর্মী সেই মুসলিম যুবকের উদ্দেশে ধমক দিয়ে বলেন, ‘এই মেয়ের পাশে দাঁড়ানোর সাহস কোত্থেকে পেলি তুই?’ আরেক কর্মী বলেন, ‘এই ব্যাটার ফোনে মেয়েটির ছবি আছে।’ ঠিক এ জায়গাতে শেষ হয় ভিডিও চিত্রটি।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা টাইমস অব ইন্ডিয়াকে জানিয়েছেন, তরুণী আঘাত করার পরও কানে ধরে এবং হাঁটু গেড়ে ওই গাছের তলায় প্রায় আধাঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়েছিল যুবককে এবং এই অবস্থায় চলেছিল মারধর।
ওই তরুণী বলেন, প্রথমে মারধর করে তারা। তার পর তরুণীকে বলা হয় তার সঙ্গীর গালে জুতো দিয়ে মারতে। প্রথমে তিনি আলতো করে এক বার মারেন। কিন্তু তাতে শান্তি হয়নি ওই দলের। বারবার জোরে মারতে বলা হয়। একাধিকবার তরুণীকে জুতো মারতে বাধ্য করে ওই সংগঠনের সদস্যরা। এখানেই শেষ নয়, তারপরেও কান ধরে বসিয়ে রাখা হয় ওই যুবককে। শেষে মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় থানায়।
ইতোমধ্যে ঘটনাস্থলে পুলিশ উপস্থিত হলে মঞ্চের কর্মীরা পুলিশকে জানায়, মুসলিম এই যুবক ওই তরুণীর সঙ্গে গাছের তলায় জোর জবরদস্তিমূলক আচরণ করছিল। তবে ওই তরুণী পুলিশকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, ওই যুবক তার সঙ্গে কোনো বাজে আচরণ করেননি এবং তিনি নিজের ইচ্ছা ও সজ্ঞানে গাছের তলায় ওই যুবকের সঙ্গে অবস্থান করছিলেন।
মিরাট শহরের পুলিশ কর্মকর্তা দেবেশ সিং টাইমস অব ইন্ডিয়াকে এ সম্পর্কে বলেন, ‘ওই তরুণী আমাদের জানিয়েছেন, মারধরের শিকার ওই যুবকের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে এবং ওই দিন তিনি নিজের ইচ্ছেতেই ওই যুবকের সঙ্গে অবস্থান করছিলেন। হিন্দু জাগরণ মঞ্চ যে অভিযোগ করেছিল,তার কোনো ভিত্তি নেই।’
ওই তরুণী অভিযোগ না করায় যুবককে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। শেষে অন্য এক জনকে দিয়ে একটি অভিযোগ দায়ের করানো হয় মঞ্চের তরফ থেকে। কিন্তু পুলিশ বুঝতে পারে, আসলে জোর করে সেই অভিযোগ দায়ের করানো হয়েছে। পাল্টা হিন্দু জাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন ওই তরুণী। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে হিন্দু জাগরণ মঞ্চের কয়েক জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এ ঘটনায় দাঙ্গা, মারধর ও সাম্প্রদায়িক উস্কানির অভিযোগে শচীন সিরোহি ও তার অনুগত কর্মীদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্য একটি মামলা করা হয়েছে উল্লেখ করে দেবেশ সিং বলেন, ‘শচীন সিরোহি ও তার কর্মীদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।’
তবে শচীন সিরোহি জানিয়েছেন তিনি কোনো অন্যায় করেননি। এ বিষয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়াকে তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু আমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত লোকজনকে সমাজবিরোধী উপাদান থেকে বাঁচাতে চেয়েছি।’
বিশিষ্টরা বলছেন, বিজেপি শাসিত দেশটিতে মুসলিম নির্যাতনের ভয়াবহতা বেড়েছে। সবসময় আতঙ্কে থাকে সংখ্যালঘু মুসলিমরা। প্রায় প্রতিদিনই দেশটির কোথাও না কোথাও সংখ্যালঘু নির্যাতনের এই দৃশ্য দেখা যায়। দেশটিতে সংখ্যালঘুরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে আফগানিস্তানের উত্তাল পরিস্থিতিতে ভারতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি আরও উত্তেজিত করে তুলেছে। আর এসবের দায় বিজেপি সরকারের ঘাড়েই দিতে চান বিশিষ্টরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫০
আপনার মতামত জানানঃ