জলবায়ু পরিবর্তন সন্তান জন্মদানে অনীহা কিংবা ভয় তৈরি করছে বিশ্বের তরুণদের মধ্যে৷ ‘বার্থস্ট্রাইক’ নামে বিশ্বব্যাপী একটি ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছিল বেশ কয়েকবছর আগে। এবার নতুন এক গবেষণায় আবারও সামনে আসল একই প্রসঙ্গ।
বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে সতর্ক করেছেন, গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে অভূতপূর্ব কোনো পদক্ষেপ না নিলে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের আরো শত শত মিলিয়ন মানুষ বিপদের সম্মুখীন হবে৷
কম সন্তান নেওয়া, বিমানে কম চড়া এবং উদ্ভিদ জাতীয় খাবার খেয়ে উন্নত বিশ্বের মানুষ ব্যক্তিগতভাবে গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে পারেন বলে বিজ্ঞানীদের ভাষ্য৷
অনেকে মনে করেন, এমতাবস্থায় পৃথিবীর জনসংখ্যা আর বাড়ানো এক ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা৷ কারণ, ২০১৭ সালের ৭৬০ কোটি থেকে ২০৫০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ১০০০ কোটি হতে চলেছে, যা কার্বন নিঃসরণ ও সম্পদের সমস্যা বাড়ানোর বড় কারণ হবে৷
তাই বিশ্বের তরুণ প্রজন্মের প্রতি ১০ জনের মধ্যে চার জনই আর চাইছেন না সন্তানের জন্ম দিতে। তারা আর এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন না বংশগতির ধারা। রেখে যেতে চাইছেন না নিজেদের উত্তরাধিকার।
কারণ সেই অধিকার সামলানোর মতো পরিস্থিতি আগামী ও তার পরের প্রজন্মের শিশুদের আর থাকবে বলে বিশ্বাস করছেন না এখনকার তরুণ প্রজন্মের ৪০ শতাংশই। যাদের বয়স ১৬ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে।
তাছাড়া, ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের ১০ জনে প্রায় ৬ জনই জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তরুণ প্রজন্মের অর্ধেকেরও বেশি (৫৬%) বলেছে, তারা মনে করে মানবতা ধ্বংস হয়ে গেছে।
আর তরুণ সমাজের দুই-তৃতীয়াংশই জলবায়ুর বেহাল অবস্থার জন্য অত্যন্ত উদ্বিগ্ন, দুঃখিত, লজ্জিত, ক্ষুব্ধ, শঙ্কিত ও হতাশ বোধ করে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে প্রচুর নেতিবাচক চিন্তা মাথায়
এতে দেখা গেছে, তরুণ-যুবাদের প্রায় ৬০ শতাংশই জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন কিংবা চরম উদ্বেগ বোধ করে।
বিবিসি জানায়, জরিপে অংশ নেওয়া যুব সমাজের প্রতিনিধিদের ৪৫ শতাংশেরও বেশি জন বলেছেন, জলবায়ু নিয়ে তাদের যে অনুভূতি, তা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এবং কাজকর্মে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ভারত, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও ব্রিটেন-সহ ১০টি দেশের তরুণ প্রজন্মের (১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সি) উপর চালানো সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা এই উদ্বেগজনক খবর দিয়েছে।
সমীক্ষার ভিত্তিতে লেখা গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হতে চলেছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘দ্য ল্যানসেট প্ল্যানেটারি হেল্থ’-এ।
গত মঙ্গলবার সেটি অনলাইনে প্রকাশ করা হয়েছে। গবেষণাপত্রটির শিরোনাম ‘ইয়ং পিপল্স ভয়েসেস অন ক্লাইমেট অ্যাংজাইটি, গভর্নমেন্ট বিট্রেয়াল অ্যান্ড মর্যাল ইনজুরি: আ গ্লোবাল ফেনোমেনন’।
গবেষণায় বলা হয়, খুব দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর ভবিষ্যত যে ভয়ঙ্কর ও ভয়াবহ; এ কথা মেনে নিচ্ছেন তরুণ প্রজন্মের তিন-চতুর্থাংশ। তরুণ প্রজন্মের অর্ধেকেরও বেশি মনে করছেন, আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাদের হাতে সুযোগ তাদের আগের প্রজন্মের চেয়ে অনেক কম রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে রোজকার কাজকর্ম, জীবিকা, জীবন ও সম্পত্তির যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, হয়ে চলেছে, তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তরুণ প্রজন্মের প্রায় অর্ধেক অংশই।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তনে তরুণ প্রজন্মের উদ্বেগ নিয়ে এত বড় মাপের সমীক্ষাভিত্তিক গবেষণা এর আগে হয়নি। গবেষণাটি যৌথভাবে চালিয়েছে অক্সফোর্ড হেল্থ এনএইচএস ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট-সহ আমেরিকা, ব্রিটেন ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়।
গবেষকরা জানিয়েছেন, বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলি আর এক-দু’দশকের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে লাগাম টেনে ধরতে পারবে, এমনটা মনে করছে না আধুনিক তরুণ প্রজন্ম।
বরং তারা মনে করছেন, রাষ্ট্রগুলোর গাফিলতি, উদাসীনতা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাজের ফলেই উষ্ণায়ন বেড়ে চলেছে, বাড়বে আগামী দশকগুলোতেও। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের গতি কমানো সম্ভব হবে না। বিপন্ন হয়ে পড়বে আগামী ও তার পরের প্রজন্মের শিশুদের ভবিষ্যত। তারা আগের প্রজন্মকেও এর জন্য দায়ী করতে দ্বিধা বোধ করেননি।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে উদ্বেগ জন্মহারে কতটা প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো উপাত্ত পাওয়া যায়নি৷ তবে ২০১৭ সালের এক হিসেব থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি নারীর গড় সন্তানের সংখ্যা ১ দশমিক ৮-এ নেমে এসেছে, যা ইতিহাসের সর্বনিম্ন৷
প্রসঙ্গত, কম-সন্তান জন্মদানকে উন্নত বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে একটি সফল উদ্যোগ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল ২০১৭ সালের এক গবেষণায়৷ ওই গবেষণায় দেখানো হয়, একটি সন্তান কম জন্ম দিলে, ভবিষ্যতে তিনি এবং তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের হাত থেকে বিশ্ব প্রতিবছর ৫৮ টন কার্বন ডাই অক্সাইড রক্ষা পাবে৷
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৮৩২
আপনার মতামত জানানঃ