বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে প্রতি মাসে কয়েক হাজার কোটি টাকা ভাড়া দেওয়ার ঘটনা এই উন্নয়নের জোয়ারে ডালভাত হয়ে গেছে। মূলত দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণে এমনভাবে চুক্তি করা হয় যে সেগুলো বসে থাকলেও মাসে মাসে ভাড়া দিতে হবে। এটাকে বলা হচ্ছে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’। কয়েক বছর ধরেই দেশে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা অনেক বেশি। ফলে যেসব কেন্দ্রের উৎপাদনক্ষমতা কাজে লাগে না, সেগুলোকে নিয়মিত ভর্তুকি দিতে হয়। এরপরেও একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যৌক্তিকতা জানে না খোদ বিশেষজ্ঞরাই।
বছরে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) গত বছর এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, বাংলাদেশে মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাত্র ৪৩ শতাংশ ব্যবহার করা হয়, বাকি ৫৭ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, অলস কেন্দ্র বসিয়ে রেখে বছরে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার।
বিদ্যুৎ বিভাগের গত ১০ জুনের হিসাব অনুযায়ী, সরকারি, বেসরকারি ও যৌথ উদ্যোগে দেশে মোট ১৪৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ৫৭, বেসরকারি ৯১ ও ১টি যৌথ উদ্যোগের। বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্থাপিত সক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি (ক্যাপটিভ ও অফ-গ্রিড নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাদে)। প্রকৃত সক্ষমতা ২১ হাজার মেগাওয়াটের মতো। বিপরীতে উৎপাদন হয় মাত্র ১৩ হাজার মেগাওয়াটের আশপাশে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গত জুনে এক প্রতিবেদনে মে মাসের এক দিনের হিসাব তুলে ধরে জানিয়েছিল, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৬০ শতাংশই অব্যবহৃত থাকছে। অলস কেন্দ্রগুলোকে ভর্তুকি দিতে গিয়ে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও বিভিন্ন সংস্থাকে ঋণ দেওয়ার জন্য ৪৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ভর্তুকিতে কৃষির পরে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বিদ্যুৎ খাত। এই খাতে চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি বরাদ্দ ৯ হাজার কোটি টাকা।
সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র অপচয়ের খনি
সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পটুয়াখালীর পায়রায় দুই ইউনিটের নির্মাণকাজ শেষ হলেও নেই সঞ্চালন লাইন। ফলে বসিয়ে বসিয়ে ভাড়া দিতে হচ্ছে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রেও। বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হলেও সঞ্চালন লাইন নির্মাণ না করা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত বছরের মে মাসে একটি ইউনিটে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়। এরপর গত ডিসেম্বরে উৎপাদনে আসে দ্বিতীয় ইউনিট। তবে দুই ইউনিট পুরো সক্ষমতায় চালানো যায় না। কারণ, দুই ইউনিটে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে, তা সঞ্চালন করার মতো লাইন নেই।
উল্লেখ্য, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রতি ইউনিটের উৎপাদনক্ষমতা ৬৬০ মেগাওয়াট, মোট ক্ষমতা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, পায়রার বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ চলছে। রাজধানীর আমিনবাজার থেকে মাওয়া-গোপালগঞ্জ হয়ে বাগেরহাটের মোংলা পর্যন্ত ৪০০ কিলোভোল্টের (কেভি) সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ শেষ হলে পায়রার বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে দেওয়া যাবে। তার আগপর্যন্ত পুরো সক্ষমতায় পায়রার বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো সম্ভব নয়।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘আমরা আশা করছি আগামী বছর লাইন নির্মাণের কাজ শেষ হবে। করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় কাজে বিঘ্ন ঘটেছে। যত দিন বিদ্যুৎ নিতে না পারব, তত দিন আমাদের ক্যাপাসিটি চার্জ (বসিয়ে ভাড়া) দিতে হবে।’
নসরুল হামিদ বলেন, যে ঠিকাদারকে সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজটি দেওয়া হয়েছিল, তারা দেরী করেছে। সে জন্য তাদের বাদ দিয়ে নতুন করে চায়না মেশিনারিজ কোম্পানিকে (সিএমসি) ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, সরকারের পরিকল্পনায় থাকা বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত উৎপাদনে এসেছে পায়রা। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা।
পায়রা চালু হওয়ার আগে দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ঘাটের মেঘনা পাওয়ার লিমিটেড (এমপিএল)। এর উৎপাদনক্ষমতা ৪৫০ মেগাওয়াট।
এদিকে, পায়রার পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করতে না পারায় প্রতি মাসে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানিকে ১০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন বলেন, ১০০ কোটি টাকার মধ্যে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি লিমিটেড (পিজিসিবি) ২০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। কারণ, তারা নির্ধারিত সময়ে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করতে পারেনি।
বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে, দেশের সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা গ্যাসভিত্তিক, মোট ক্ষমতার ৫২ শতাংশ। এর বাইরে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রের ক্ষমতা ২৭, ডিজেলের ৬ ও কয়লার ৮ শতাংশ। বাকিটা জলবিদ্যুৎ ও আমদানির বিদ্যুৎ।
গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ইউনিটের উৎপাদন ব্যয় ৩ টাকার কম। আর কয়লায় ৭ টাকার বেশি। জ্বালানি তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়, প্রতি ইউনিটে ২০ টাকার মতো।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরো সক্ষমতায় চালানো গেলে কম খরচে ৬০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ পাওয়া যেত, যা বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ কমাতে ভূমিকা রাখত।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, সরকার শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন করে যাচ্ছে। উৎপাদনের সঙ্গে চাহিদার কোনো সমন্বয় নেই। তিনি বলেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে, তা দেশের টাকার অপচয়। এভাবে অপচয় করা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪১৪
আপনার মতামত জানানঃ