কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির অবনতিতে পানিবন্দি হয়ে লাখো মানুষ দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছে। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির শঙ্কটে কয়েক গ্রামের মানুষ চরম নিশ্চয়তায় কোনোরকমে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কারও গবাদিপশু পানিতে ভেসে গেছে, কারও ঘরের চাল অব্দি পানি, কারও জমি পানিতে তলিয়ে আছে দিনের পর দিন, ফলে নষ্ট হচ্ছে ফসল। এদিকে গত এক মাসে ৮ টি স্কুল নদীগর্ভে যাবার পাশাপাশি ২৫ টি হুমকির মুখে।
কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, আজ শনিবার (৪ সেপ্টেম্বর) সকাল ৬টা থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কুড়িগ্রামের চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমা র ৪৪ সেন্টিমিটার ওপর ও ধরলা নদীর পানি কুড়িগ্রাম সদরের ধরলা সেতু পয়েন্টে বিপদসীমার ৫১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। লালমনিরহাট সদর উপজেলার শিমুলবাড়ী পয়েন্টে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে আজ ভোরে তিস্তার পানি লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর থাকলেও সকাল ৬টা থেকে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এর ফলে জেলার ১২টি ইউনিয়নের চর, দ্বীপচর ও নিম্নাঞ্চলের অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় ১০ হাজার পরিবারের অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ।
এছাড়া বন্যার পানিতে জেলার ২৫ হাজার ১৫০ হেক্টর বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত নিমজ্জিত হয়েছে। এরমধ্যে ২৪ হাজার ৭৫০ হেক্টর রোপা আমন, ১১৫ হেক্টর আমন বীজতলা এবং ২৮০ হেক্টর শাকসবজি ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান সরকার।
ভুক্তভোগীর ভোগান্তির চিত্র
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ গ্রামের পানিবন্দি কৃষক সেকেন্দার আলী এক জাতীয় দৈনিককে বলেন, ‘আমার একটি ছাগল ও কয়েকটি হাঁস-মুরগি পানিতে ভেসে গেছে। গরু-ছাগলগুলো উঁচু স্থানে রেখেছি।’
তিনি বলেন, ‘ঘরের ভেতর দুই থেকে তিন ফুট পানি। পরিবারের লোকজন নিয়ে খাটের উপরে বসবাস করছি। ঘরে খাবার নেই। নলকূপ পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় পান করার মতো বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছি না। গেল আট দিন ধরে এই অবস্থায় দিন কাটাচ্ছি।’
একই গ্রামের কৃষক বজলে রহমান ঐ দৈনিককে বলেন, ‘ঘরে খাবার আছে কিন্তু রান্নার সুযোগ নেই। চিড়া, মুড়ি, গুড় ও পাউরুটি খেয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। মাঝে মধ্যে আত্মীয় স্বজনরা রান্নাকরা খাবার দিয়ে সহায়তা করছেন। নলকূপ পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই নদীর পানি পান করতে হচ্ছে। ঘাসের জমিগুলো পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় গরু-ছাগল নিয়ে দূরবস্থায় পড়েছি।’
লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার গোবর্ধান গ্রামের কৃষক মোবারক আলী বলেন, ‘বাড়ি-ঘর ছেড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধে আশ্রয় নিয়েছি। ঘরে খাবার না থাকায় অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। আমন ধান ও সবজি ক্ষেতগুলো তলিয়ে গেছে।’
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মঞ্জুরুল হক বলেন, ‘প্রায় ২৬ হাজার হেক্টর জমির আমন ধান ও সবজির ক্ষেত পানির নিচে। অনেক স্থানে ফসলের ক্ষতি হয়েছে। আগামী ২-৩ দিনে মধ্যে বন্যার পানি নেমে না গেলে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হবে।’
এক মাসে ৮ টি স্কুল পানিগর্ভে, ২৫ টি হুমকির মুখে
গত এক মাসে তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমারের ভাঙনে নদীগর্ভে চলে গেছে আটটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে আরও ২৫টি স্কুল। ভাঙন কবলিত বিদ্যালয়গুলোর আসবাবপত্র সরিয়ে রাখা হয়েছে। তবে নতুন করে বিদ্যালয় নির্মাণের জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না বলে স্থানীয়রা।
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তার বুকে ভাঙন কবলিত চিলমারীপাড়া গ্রামের সেকেন্দার আলী (৫৮) এক জাতীয় দৈনিককে বলেন, ‘তিস্তার অনবরত ভাঙনে নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে দক্ষিণ সিন্দুর্না প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। এটি এই চরে একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিদ্যালয়টি এই চরে পুনর্নির্মাণ করা না হলে ছেলে-মেয়েরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়বে।’
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার পশ্চিম বজরা গ্রামের আক্কাস আলী মন্ডল (৬০) বলেন, ‘তিস্তার ভাঙনে পশ্চিম বজরা প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নদীগর্ভে চলে গেছে। বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র রক্ষা করা হয়েছে। জায়গার অভাবে বিদ্যালয় পুনর্নির্মাণ করা যাচ্ছে না। বিদ্যালয়টি এখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হলে চরের শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে।’
এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘স্কুল রক্ষার্থে কয়েকটি জায়গায় বালুভর্তি জিও ব্যাগ, জিও টিউব ফেলা হচ্ছে। কয়েকটি স্কুল ঝুঁকিমুক্ত করাও সম্ভব হয়েছে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে বন্যা পরিস্থিতি অবনতির কারণ
বিশেষজ্ঞদের মতে, মানবসৃষ্ট যে কাজগুলোর কারণে বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে, তা নিয়ে উচ্চাসনে বসা ব্যক্তিদের দৃষ্টিপাত কম বলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে হিমহিশ খেতে হচ্ছে।
নদী প্রণালীর কৃত্রিম পরিবর্তন বন্যাকে প্ররোচিত করে। পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পানিসেচের কারণে নদী প্রণালীতে বাঁধ এবং বিজার্ভার নির্মিত হলে নদীর নিজস্ব অববাহিকায় বন্যা দেখা দিতে পারে। বর্ষাকালে অতিবর্ষণ এবং বাঁধ বা রিজার্ভার থেকে পানিনির্গমন যদি যুগপৎ ঘটে তাহলে নির্গত প্রবাহের আধিক্যের কারণে নদীর নিজস্ব অববাহিকায় বন্যা সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া নদী প্রণালীতে বাঁধ দিয়ে এবং খাল কেটে নদীকে ভিন্নমুখী করলেও ভিন্নমুখ নদী সন্নিকটস্থ সমতলে বন্যা ঘটাতে পারে।
এদিকে নদীর বাঁধ, বন্যা প্রাচীর এবং বন্যাপ্রবণ নিচু অঞ্চলে অবৈধভাবে জনবসতি গড়ে ওঠায় নদী প্রণালী ক্রমসঙ্কুচিত হচ্ছে। এছাড়া পৌরসংস্থার জঞ্জাল এবং নর্দমা নির্গত আবর্জনার প্রভাবে নদীগর্ভ ক্রমশ ভরাট হচ্ছে, ফলে নদী প্রণালীর হ্রাস পাচ্ছে। এইসব কারণে নদীপার্শ্বস্থ প্রাকৃতিক ভৌত পরিবেশ ধ্বংস হওয়ায় বর্ষাকালে নদীতে বন্যা প্ররোচিত হচ্ছে।
বন্যার সময় কেবল ত্রাণ দিয়ে, বন্যা রোধে ব্যবস্থা না নিলে কেবল ত্রাণ সহায়তায় লাখো মানুষের দুর্ভোগ দূর করা সম্ভব নয়। এদিকে পর্যাপ্ত মানুষের কাছে ত্রাণ পৌছানোর সুব্যবস্থাও নেই। এজন্য কেবল ত্রাণ বিতরণ করে দায়সারা না হয়ে বন্যা রোধে পরিকল্পিত ব্যবস্থা দরকারি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৪১০
আপনার মতামত জানানঃ