জনগণের কোটি টাকা নষ্ট করে একাধিক স্থানে স্লুইসগেট তৈরী করছে পাউবো; যার আদৌ কোনো কার্যকারীতা নেই। এসব স্লুইসগেটের সুফল তো আসছেই না বরং ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে এলাকাবাসীকে।
এর মধ্যে একটি হলো সাতক্ষীরা সদরের ধুলিহর ইউনিয়নের কোমরপুর এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনে তিন বছর আগে তৈরী একটি স্লুইসগেট। তবে দুই কোটি টাকায় হাজিখালি খালের মুখে নির্মিত এই স্লুইসগেটটি কোনো কাজেই আসেনি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সাতক্ষীরা জেলায় পানি নিষ্কাশনে তৈরি করা অধিকাংশ স্লুইসগেটেরই কোনো কার্যকারিতা নেই। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর গত তিন বছরে এক ফোঁটা পানিও বিল থেকে নদীতে নিষ্কাশন করতে পারেনি স্লুইসগেটটি। উল্টো নদীর পানি বিলে ঢুকে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
স্লুইসগেট প্রসঙ্গে সাতক্ষীরার পাউবো কর্তৃপক্ষ জানায়, এটি দুর্যোগপূর্ণ, বন্যাকবলিত ও লবণাক্ত উপকূলীয় এলাকা। এ অঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি নিষ্কাশন, কৃষিজমি সম্প্রসারণ ও লবণাক্ততা থেকে রক্ষায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সাতক্ষীরা বিভাগ-২-এর আওতায় পোল্ডার রয়েছে সাতটি। এর মধ্যে পোল্ডার ২ ও সম্প্রসারিত ২-এর আওতায় পড়েছে সাতক্ষীরা সদর, কলারোয়া ও আশাশুনি উপজেলা। পোল্ডারটির পূর্বে বেতনা নদী ও দক্ষিণ-পশ্চিমে মরিচ্চাপ নদীবেষ্টিত।
পাউবো কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, এ প্রকল্পের আওতায় উপকৃত এলাকায় জমির পরিমাণ ১১ হাজার ২৯৬ হেক্টর। এখানে বাঁধ রয়েছে ৬২ দশমিক ৯৫০ কিলোমিটার এবং স্লুইসগেট রয়েছে ২১টি। খাল রয়েছে ৬৫ দশমিক ২২০ কিলোমিটার।
পাউবো একের পর এক অপরিকল্পিত স্লুইসগেট নির্মাণ করে সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয় করছে। কোমরপুরের স্লুইসগেটটিও তেমনই একটি প্রকল্প। কোমরপুর গ্রামের রফিকুল ইসলাম সরদার জানান, কলারোয়া থেকে সাতক্ষীরা সদর হয়ে আশাশুনি পর্যন্ত বেতনা নদীর দুই তীরের গ্রামগুলো পানিতে ডুবে আছে। জুলাইয়ে তিন দিনের বৃষ্টিতে গ্রামের পর গ্রাম পানিতে ডুবে গেলেও হাজিখালি খালের মুখে নির্মিত স্লুইসগেটটি দিয়ে কোনো পানিই নিষ্কাশন হয়নি।
তিনি আরও জানান, তিন উপজেলার শতাধিক গ্রামের ঘরবাড়ি, কবরস্থান, রাস্তাঘাট ডুবে রয়েছে প্রায় এক মাস। রান্নাঘরের চুলা ডুবে থাকায় সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে হাজারও পরিবার। বাড়িতে যাতায়াত করতে রাস্তার ওপর সাঁকো তৈরি করা হয়েছে।
একই গ্রামের নূর ইসলাম সরদার বলেন, ‘একটু বৃষ্টি হলেই ভেসে যায় আমাদের আয়ের উৎস মৎস্যঘের। আমরা নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি। সামান্য বৃষ্টিতে সব তলিয়ে যায়। এখনো গ্রামের পর গ্রাম পানিতে। প্রায় দুই কোটি টাকার হাজিখালি বিলের স্লুইসগেট পানি নিষ্কাশনে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না।’
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের পওর বিভাগ-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুর রহমান বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। নতুন স্লুইস কোথায়, কয়টি, কত টাকায় নির্মিত হয়েছে, তা আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে জানাব।’
এদিকে বরগুনায় ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও জলাবদ্ধতা নিরসনে স্লুইজ গেটগুলোর অধিকাংশই কোনো কাজে আসছেনা। বাংলাদেশ সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) আশি ও নব্বইয়ের দশকে নতুন করে বাঁধ ও হাইড্রোলিক স্লুইচগেট নির্মাণ করে। রক্ষণাবেক্ষণের লোকের অভাবে ভেঙে গেছে স্লুইসের ঢাকনা, এখন ইচ্ছামতো জোয়ারে পানি ঢোকে, ভাটায় পানি শুকায়। ফলে প্রয়োজনের সময় পানি মেলে না আর নিষ্কাশনের সময় কাজে আসে না স্লুইসগেট।
বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, জেলার বিষখালী, বলেশ্বর ও পায়রা নদীর বেড়িবাঁধের ওপরে ষাটের দশকে ৩৮০টি স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়েছিল। এর বেশির ভাগই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের সঙ্গে নির্মাণ করা হয়েছিল।
১৯৭০ সালের বন্যার পর আরও কিছু স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়। আশির দশকে নদীভাঙনের কবলে ভেঙে যাওয়া স্লুইসগুলো পুনর্নির্মাণ করা হয়। নব্বই ও ২০০০ সালের পর কয়েক দফায় ভাঙনে বিলীন হওয়া স্থানে আবারও স্লুইসগেট বানানো হয়।
বরগুনা পাউবোর ২২টি পোল্ডারের মধ্যে ২০টিতে মোট ৩৮০টি স্লুইসগেট রয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই নদী লাগোয়া বেড়িবাঁধের ওপর। নদী সংযুক্ত খালে পানি প্রবাহের জন্য এই গেটগুলো বানানো হয়েছিল।
স্থানীয়রা জানান, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও জলাবদ্ধতা নিরসনে স্লুইসগেটগুলোর অধিকাংশই কোনো কাজে আসছে না। উপকারভোগীরা পরিণত হয়েছেন ভুক্তভোগীতে।
তারা জানান, সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এসব স্লুইসগেট অকার্যকর হয়ে উপকারের চেয়ে বেশি ক্ষতি করছে। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের সময় জলোচ্ছ্বাসের অন্যতম কারণ ছিল এসব স্লুইসগেট।
বালিয়াতলী ইউনিয়নের বাসিন্দা দেলোয়ার গাজী বলেন, ‘এবার ইয়াসের সময় এই স্লুইসগেট থেকে খালে জোয়ারের পানি ঢুকে উভয় পারের লোকালয় প্লাবিত হয়েছে। এলাকার কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। লবণ-পানি ঢুকেছে পুকুরে, ফসলি জমিতে। এই স্লুইসগেট এখন আমাদের জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
বরগুনার এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের চালিতাতলী এলাকার পায়রা নদীর স্লুইসটির পানি নিয়ন্ত্রণের লোহার গেট ভেঙে গেছে অনেক আগেই।
পায়রা নদীর ভাঙনে পড়েছে আমতলীর ছোটবগী ইউনিয়নের বঙ্গোপসাগর ও পায়রা নদীর মোহনার কোলঘেঁষা চরপাড়া গ্রামের বেড়িবাঁধ। স্লুইসগেটের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। যাতায়াতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে মানুষকে।
পাউবোর বরগুনা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী কাইছার আলম বলেন, ‘বাঁধের পাশাপাশি স্লুইচগেটগুলোর সংস্কার জরুরি। স্লুইসগেটের নিয়ন্ত্রণ না থাকলে জোয়ারের পানি লোকালয়ে ঢোকে। আমরা এরই মধ্যে বেশ কিছু স্লুইসের সংস্কার কাজ হাতে নিয়েছি। বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে সংস্কারের আওতায় আনা হবে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের নিম্নাঞ্চলে যে উদ্দেশ্যে কোটি টাকা খরচ করে এক একটি স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়েছিল, তা আদৌ সফল হয়নি। বরং বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে মানুষের ভোগান্তিকে দীর্ঘায়িত করেছে। যথাযথ সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব না হলে এই স্লুইসগেটের কারণেই নিম্নাঞ্চলের মানুষ বছরের বড় একটা সময় পানিবন্দি থাকবে নিয়মিতভাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/২০১৮
আপনার মতামত জানানঃ