বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এমনিতেই বেশ নাজুক। কোভিড-১৯ মহামারি সে সংকট আরও গভীর করে তুলেছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হচ্ছে গর্ভধারণকারী মায়েদের। করোনাভাইরাসের মধ্যে দেশে ১৭ শতাংশ মাতৃমৃত্যু বেড়েছে। একইসাথে প্রসবের আগে যথাসময়ে হাসপাতালে নিয়ে না যাওয়ায় দেশে ৫৪ শতাংশ নারীর মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন ইউনিলিভার বাংলাদেশ (ইউবিএল) ও বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের (বিএইচআরএফ) যৌথ আয়োজনে ‘করোনাকালে মাতৃস্বাস্থ্য এবং বাবার দায়িত্ব’ শীর্ষক ওয়েবিনারের বক্তারা।
আজ সোমবার ইউনিলিভার বাংলাদেশ (ইউবিএল) এবং বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএইচআরএফ) এর যৌথ আয়োজনে ‘করোনাকালে মাতৃস্বাস্থ্য এবং বাবার দায়িত্ব’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা মাতৃস্বাস্থ্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনায় এসব কথা বলেন। ‘বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ ২০২১’ উপলক্ষে এই ওয়েবিনারে আয়োজন করা হয়। তাদের আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে বাংলাদেশে মাতৃস্বাস্থ্যের বিভিন্ন ঝুঁকি, মাতৃত্বকালীন সময়ে সন্তানের বাবা ও পরিবারের দায়িত্ব, মাতৃদুগ্ধের গুরুত্ব এবং করোনাকালে প্রসূতিসেবার সংকটগুলো।
বিএইচআরএফ এর সাধারণ সম্পাদক রাশেদ রাব্বির সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শফি আহমেদ, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনী ও প্রসূতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল।
ওয়েবিনারে মাতৃস্বাস্থ্য বিষয়ে প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মুরাদ আহমেদ। এছাড়া, অনুষ্ঠানে আরও যোগ দেন ইউনিলিভার কনজ্যুমার কেয়ার লিমিটেড (ইউসিএল) এর করপোরেট অ্যাফেয়ার্স পার্টনারশিপস অ্যান্ড কমিউনিকেশনের প্রধান শামীমা আক্তার, বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরাম এর সভাপতি তৌফিক মারুফসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা।
করোনাভাইরাসের মধ্যে মাতৃমৃত্যু নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মাতৃমৃত্যু বেড়েছে ১৭ শতাংশ। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২০১৯ সালে সন্তান জন্মদানের সময় ৯৬৭ জনের মৃত্যু হয়। এটি ২০২০ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৩৩ জনে।
ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রথমবার গর্ভধারণ করা অধিকাংশ মা-ই কিশোরী। মা হতে গিয়ে তাদের যে মৃত্যুঝুঁকিতে পড়তে হয় তা পরিবারের অন্য সদস্যরা ভাবেন না। প্রসবকালীন ঠিক সময়ে হাসপাতালে না নিয়ে যাওয়ার ফলে দেশে মাতৃমৃত্যুর ৫৪ শতাংশ ঘটে বাড়িতে।
‘করোনাকালে মায়েদের সেবাকেন্দ্রে যাওয়ার প্রতিবন্ধকতা আরও বেড়েছে। পরিবার ও সন্তানের বাবার সহযোগিতা ছাড়া এই সংকট কাটিয়ে ওঠা কঠিন। মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের জন্য আমাদের এখন এক সামাজিক যুদ্ধে নামতে হবে।’
ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শফি আহমেদ দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাতৃস্বাস্থ্য সমস্যার প্রতি দৃষ্টিপাত করেন।
তিনি বলেন, ‘করোনা ও লকডাউনের কারণে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোতে মাতৃস্বাস্থ্য সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। পরিবারের উপর্জনকারী ব্যক্তি যেমন বাবারা কর্মহীন হওয়ায় তারা সন্তানের মায়ের যথাযথ যত্ন নিতে পারছেন না। মাতৃস্বাস্থ্যের গুরুত্বের বিষয়টি এই সময়ে আরও বেশি করে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাবাদের উচিত মাতৃত্বকালীন সন্তানের মায়েদের প্রতি আরও যত্নবান হওয়া ও মায়েদের কাজগুলো ভাগ করে নেয়া। একই সঙ্গে মা ও শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও বাবাকে ভাবতে হবে। কোভিড-১৯ সময়ে এ বিষয়টিও নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।’
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এমনিতেই বেশ নাজুক। করোনার মহামারি সে সংকট আরও গভীর করে তুলেছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হচ্ছে অন্তঃসত্ত্বাদের। করোনাকালে তাদের সুরক্ষা ও এ সময়ে বাবাদের দায়িত্বের বিষয়টি উঠে এসেছে ওয়েবিনারে।
এতে মাতৃস্বাস্থ্য বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মুরাদ আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের নারীরা গর্ভকালে এমনিতেই অপুষ্টিতে ভুগেন। এর সঙ্গে করোনাকালে যোগ হয়েছে বাল্যবিবাহের বাড়তি ঝোঁক। অল্প বয়সে মা হওয়ার সিদ্ধান্ত মায়েদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
‘এসব বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের ভাবতে হবে। আশার বিষয় হচ্ছে, মায়েরা এখন চাইলে কোভিড-১৯ টিকা নিতে পারছেন। সর্বোপরি মাতৃত্ব নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেয়া চলবে না।’
অনুষ্ঠানে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিএল) করপোরেট অ্যাফেয়ার্স পার্টনারশিপস অ্যান্ড কমিউনিকেশনের প্রধান শামীমা আক্তার বলেন, “করোনাকালে মাতৃদুগ্ধের প্রয়োজনীয়তা ও মায়ের সুস্বাস্থ্যের বিষয়টি সবার মাঝে ছড়িয়ে দেবার কথা ভেবেই বিএইচআরএফকে সঙ্গে নিয়ে আমরা এই ওয়েবিনারের উদ্যোগ নিয়েছি। এ ছাড়া মাতৃদুগ্ধ পান নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও উৎসাহ তৈরি করতে ‘হরলিক্স মাদার’স প্লাস’ ইতোমধ্যে মাসব্যাপী ক্যাম্পেইন পরিচালনা করেছে। দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে মাতৃস্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা তৈরি করতে আমাদের এসব পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি।”
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫৬
আপনার মতামত জানানঃ