এবছরের জন্য বর্ষা মৌসুমের সমাপ্তি ঘটলেও নদীভাঙনের কারণে পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ যেন শেষ হবার নাম নিচ্ছে না। ভারত থেকে পানির ঢল আসছে হু হু করে, এতে ব্রহ্মপুত্র-যমুনাসহ আট নদী ১৫ পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করে গেছে। ১২টি জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের এসব জেলার প্রায় এক লাখ মানুষ বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, আগামী এক সপ্তাহ এসব জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হবে। অনেক এলাকায় পানি বেড়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হতে পারে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দৈনিক দুর্যোগ পরিস্থিতির প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে এরই মধ্যে বন্যাকবলিত এলাকায় নগদ অর্থ ও ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়েছে। বন্যায় পানিবন্দী মানুষের জন্য স্থানীয় সরকারি-বেসরকারি ভবনগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তথ্য অনুযায়ী, এরই মধ্যে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রাজবাড়ীসহ বন্যাকবলিত কয়েকটি জেলার মানুষ স্থানীয় উঁচু সড়ক এবং ভবনে আশ্রয় নেওয়া শুরু করেছে। এদিকে পানি বৃদ্ধি ও দমকা হাওয়ার আশঙ্কায় দেশের সবগুলো নদীবন্দরকে ১ নম্বর সতর্কসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর ১০৯টি পয়েন্টের মধ্যে ৫৩টিতে পানি বাড়ছে ও ৫২টিতে পানি কমতে শুরু করেছে।
কুড়িগ্রামে দুটি নদীর পানি বাড়ায় কয়েকটি এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। দুর্যোগ পরিস্থিতি প্রতিবেদন বলছে, এক সপ্তাহ ধরে শুরু হওয়া বন্যায় রাজবাড়ী ও বগুড়া জেলার নিম্নাঞ্চল সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও চাঁদপুরের নিম্নাঞ্চলে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। আগামী এক সপ্তাহে এসব জেলার আরও এলাকায় পানি প্রবেশ করবে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাস অনুযায়ী, দেশের প্রধান সাতটি নদ-নদীর মধ্যে পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, আত্রাই, মেঘনা, দুধকুমার ও ধলেশ্বরীর ১৪টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। আগামী এক সপ্তাহ সেখানে পানি
ভাঙনের আতঙ্কে ঘুম নেই নদীপাড়ের বাসিন্দাদের। লাখো বানভাসি মানুষের বাড়ছে কষ্ট-দুর্ভোগ। পৈত্রিক বসতভিটা, ফল-ফসল, বাগান, ক্ষেত-খামার, রাস্তাঘাট, মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিলীন হয়ে যাচ্ছে প্রমত্তা নদীগর্ভে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, সড়ক, রাস্তাঘাট ভেঙে ও ধসে পড়ছে অনেক জেলা-উপজেলায়। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা।
শুক্রবার নদ-নদীর ৬১টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৪২টিতে হ্রাস, ৬টি স্থানে অপরিবর্তিত এবং এরমধ্যে ১২টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ঊর্ধ্বে ছিল। বৃহস্পতিবার ৭২টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৩৫টিতে হ্রাস, দু’টি স্থানে অপরিবর্তিত এবং ১০টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ঊর্ধ্বে ছিল। বুধবার ৬৬টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৩৯টিতে হ্রাস, ৪টি স্থানে অপরিবর্তিত এবং ৬টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে ছিল।
নদ-নদীর প্রবাহ পরিস্থিতি ও পূর্বাভাসে পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা আগামী ৪৮ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। পদ্মা নদীর পানি স্থিতিশীল রয়েছে। যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় বৃদ্ধি পেতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কুশিয়ারা ব্যতীত প্রধান নদীসমূহের পানি হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। যমুনা নদ পুরাবাড়ি পয়েন্টে ইতোমধ্যেই বিপদসীমা অতিক্রম করেছে।
গতকাল শনিবার (২৮ আগস্ট) বিকাল পর্যন্ত প্রধান নদ-নদীসমূহের প্রবাহের সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, উত্তর জনপদ ও উত্তর-মধ্যাঞ্চলে দেশের অন্যতম প্রধান অববাহিকায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা উভয় নদ এবং এর শাখা-প্রশাখা, উপনদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদ কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে পানি আরও বেড়ে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
যমুনা নদে গতকাল আরও তিনটি স্থানে পানি বৃদ্ধি পেয়ে এখন ৭টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে। এরমধ্যে যমুনা ফুলছড়িতে বিপদসীমার ২ সে.মি., বাহাদুরাবাদে ৭ সে.মি., সারিয়াকান্দিতে ২৬ সে.মি., কাজীপুরে ১৯ সে.মি., সিরাজগঞ্জে ২৮ সে.মি., পুরাবাড়ীতে এক এবং মথুরায় দুই সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলা নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পেয়ে কুড়িগ্রামে বিপদসীমার ৩৪ এবং দুধকুমার নদী পাটেশ্বরীতে ১২ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উজানে ভারতে গজলডোবা বাঁধের পানি ছেড়ে দেয়ায় তিস্তা নদীর পানি বাড়ছে আবারও। লালমনিরহাট জেলার কাউনিয়ায় তিস্তা বিপদসীমার মাত্র ৫ সে.মি. নিচে এসে গেছে।
উত্তর-মধ্যাঞ্চলে আত্রাই নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পেয়ে বাঘাবাড়ীতে বিপদসীমার ৩৪ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মধ্যাঞ্চলে ধলেশ্বরী নদীর পানি কিছুটা বেড়ে টাঙ্গাইল জেলার এলাসিন ঘাটে বিপদসীমার ৩৬ সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে।
পদ্মা নদীর পানি কোথাও হ্রাস কোথাও স্থিতিশীল রয়েছে। পদ্মায় গোয়ালন্দে বিপদসীমার ৪৩ সে.মি. এবং সুরেশ্বরে ৮ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মাওয়া ও ভাগ্যকুলে মাত্র ৪ সে.মি. নিচে রয়েছে। মেঘনা নদীর ভাটি-মোহনায় চাঁদপুরে পানি বিপদসীমার এক সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সাতক্ষীরার কলারোয়ায় বেতনা নদীর পানি আরও কিছুটা বেড়ে বিপদসীমার ২৫ সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভুইয়া এক জাতীয় দৈনিককে বলেন, বাংলাদেশের উজানে ভারতীয় অংশে বৃষ্টিপাত বেড়ে গেছে। ফলে ওই পানি ঢল হয়ে বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদীগুলোর দিকে আসছে। যে কারণে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। আগামী এক সপ্তাহ বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।
এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস বলছে, আজ রোববার দেশের বেশির এলাকায় হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি থাকতে পারে। তবে সামগ্রিকভাবে বৃষ্টির পরিমাণ কমতে পারে। আগামী কয়েক দিন বিরতি দিয়ে আবারও বৃষ্টিপাত বাড়তে পারে। গতকাল শনিবার দেশে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে নীলফামারীর ডিমলায় ৬৭ মিলিমিটার। রাজধানীর আকাশ বেশির ভাগ সময় মেঘলা থাকলেও বৃষ্টি হয়েছে সব মিলিয়ে মাত্র এক মিলিমিটার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের মানুষের আর্থসামাজিক জীবনে বন্যা আর নদীভাঙন দীর্ঘদিন ধরে ভোগান্তির কারণ। অতিবৃষ্টি, ভারত থেকে আসা পানির ঢল, অকার্যকর ড্রেজিং সিস্টেম এবং নদীভাঙন প্রতিরোধে সরকারের নিয়মিত ব্যর্থতা এই ভোগান্তিকে কখনও শেষ না হওয়া এক চক্রে পরিণত করেছে। দেশের নিম্নাঞ্চলের মানুষের জীবনে বন্যা আর নদীভাঙন, সবটুকু সহায় সম্বল হারিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করা প্রতিবছরের স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে।
এসডব্লিউ/ডব্লিউজেএ/১১২০
আপনার মতামত জানানঃ