বস্তিবাসীদের জন্য রাজধানীর মিরপুরের বাউনিয়া বাঁধের স্লুইসগেট গেট এলাকায় ১৪তলা মোট পাঁচটি ভবন নির্মাণ করছে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে তিনটি ভবনের নির্মাণকাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। এই তিনটি ভবন ফ্ল্যাট রয়েছে ৩০০টি। এসব ফ্ল্যাট বিভিন্ন বস্তিতে থাকা ৩০০ জনকে ভাড়ায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে বস্তিবাসীদের জন্য নির্মিত ভাড়াভিত্তিক ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ফ্ল্যাট বরাদ্দের ক্ষেত্রে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক লেনদেনের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ বস্তির বাসিন্দাদের।
তাদের অভিযোগ, যারা ভাড়াপত্র হাতে পেয়েছেন, এদের মধ্যে অনেকের নিজস্ব বাড়ি রয়েছে। ভাড়াপত্র পাওয়াদের মধ্যে দ্বিতীয় তলা থেকে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত ভবনের মালিকও রয়েছেন। আবার একই পরিবারের একাধিক সদস্যের নামেও ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ব্যাচেলর, চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীর নামেও ফ্ল্যাট বরাদ্দ হয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেন।
এসব অভিযোগের প্রতিকার চেয়ে মঙ্গলবার জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ঢাকা ডিভিশন ১-এর নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে কলাবাগান বস্তিবাসীর পক্ষে লিখিত অভিযোগ জমা দেন বস্তির বাসিন্দা শেখ জাহাঙ্গীর।
অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, ২৫ বছর ধরে কলাবাগান বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপন করছি। সম্প্রতি বস্তিবাসীর জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহারের যে ৩০০ ফ্ল্যাট ভাড়ার ভিত্তিতে হস্তান্তর করা হয়েছে, সেখানে আমার মতো অনেক অসহায় গৃহহীন বস্তিবাসীর কপালে ফ্ল্যাট জুটেনি। অথচ যাদের নিজস্ব ৫ তলা, ৬ তলা কিংবা বাড়ি রয়েছে, এদের অনেকেই ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছেন। আবার একই পরিবারের ১২ থেকে ১৯ জন সদস্যও ফ্ল্যাট পেয়েছেন। এর মধ্যে এক চিহ্নিত বিএনপি নেত্রী রয়েছেন, যার পরিবারের ১৯ জন সদস্য রয়েছে। আবার যাদের ভোটার আইডি কার্ডে বস্তি লেখা নেই, তাদেরও ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি বাউনিয়া বাঁধের ২৬০০ বাস্তুহারা পরিবারের যারা দলিল পেয়েছেন, তাদের অনেকে ফ্ল্যাট পেয়েছেন। বস্তিতে যারা একসময় বসবাস করতেন, পরবর্তী সময়ে তারা বস্তি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন, তাদের অনেকে টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়েছেন।
অভিযোগের এক স্থানে শেখ জাহাঙ্গীর কয়েকজন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেন— যাদের ফ্ল্যাট পাওয়া নিয়ে আপত্তি রয়েছে বস্তিবাসীর। তারা হলেন— পারভীন, রেহেনা, হালিমা, আব্দুর রশিদ, শাহজাহান মিয়া, নজরুল ইসলাম নাঈম, সেন্টু, জহির, রফিক, হাবু, জাহাঙ্গীর, আকরাম, আক্কাস, মোশারফ ও তাছলিমা।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, ফ্ল্যাট পাওয়ার জন্য যেসব শর্ত রয়েছে, যারা এসব শর্ত গোপন করে ফ্ল্যাট নিয়েছেন, সঠিক তদন্ত করে তাদের নাম বাদ দিতে হবে। আর যারা প্রকৃত বস্তিবাসী এবং এখনও বস্তিতে বসবাস করছেন, এদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফ্ল্যাটের ভাড়াপত্র হস্তান্তর করতে হবে।
বাউনিয়া বাঁধ এলাকার বাসিন্দা রনি তালুকদার বলেন, অনেকে ধারণা করেছিল ফ্ল্যাট পেলেই এর মালিকানা পাওয়া যাবে। তাই সবাই ফ্ল্যাট নেওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন। অনেকে টাকার বিনিময়ে কিংবা লবিং করে ফ্ল্যাট বাগিয়েছেন। ওই সময় অনেক বাড়ির মালিক সুযোগ বুঝে তালিকায় তাদের নাম উঠিয়েছেন। যখন ভাড়াভিত্তিক ফ্ল্যাট দেওয়া হলো, তখন অনেকের কপালে ভাঁজ পড়ে। এখন অনেকে ফ্ল্যাট নিতে চান না কিন্তু ওই সময় যে নামের তালিকা হয়েছে, সেখানে তো গরমিল থেকেই গেছে।
অনেকে ধারণা করেছিল ফ্ল্যাট পেলেই এর মালিকানা পাওয়া যাবে। তাই সবাই ফ্ল্যাট নেওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন। অনেকে টাকার বিনিময়ে কিংবা লবিং করে ফ্ল্যাট বাগিয়েছেন। ওই সময় অনেক বাড়ির মালিক সুযোগ বুঝে তালিকায় তাদের নাম উঠিয়েছেন। যখন ভাড়াভিত্তিক ফ্ল্যাট দেওয়া হলো, তখন অনেকের কপালে ভাঁজ পড়ে। এখন অনেকে ফ্ল্যাট নিতে চান না কিন্তু ওই সময় যে নামের তালিকা হয়েছে, সেখানে তো গরমিল থেকেই গেছে।
জাহাঙ্গীরের অভিযোগে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, সে তালিকা ধরে জাতীয় দৈনিক যুগান্তরের অনুসন্ধানে মিলেছে ঘটনার সত্যতা।
স্থানীয়রা জানান, হালিমা ২ নম্বর ভবনের ৮ম তলায় একটি ফ্ল্যাটের বরাদ্দপত্র পেয়েছেন। হালিমার স্বামীর নাম মিন্টু। তাদের বাউনিয়া বাঁধ ই-ব্লকে ১১ নম্বর লাইনে একটি তিনতলা বাড়ি রয়েছে।
অন্যদের মধ্যে রেহেনার বাউনিয়া বাঁধ বি-ব্লকের ২১ নম্বর লাইনে একটি ছয়তলা বাড়ি রয়েছে। রেহেনার স্বামীর নাম হাকিম। বাসা নম্বর ৬। আক্কাসের বি-ব্লকের ২১ নম্বর লাইনে ২ তলা বাড়ি রয়েছে। পিতার নাম ফেলু খাঁ। বাসা নম্বর ৭। আব্দুর রশিদের বি ব্লকের ২০ নম্বর লাইনে ৫ তলা বাড়ি রয়েছে। পিতার নাম সুন্দর আলী বাসা নম্বর ৯। পারভীনের ই ব্লকের ৮ নম্বর লাইনে ৩ তলা বাড়ি রয়েছে। পিতার নাম কালু শিয়ালী। বাসা নম্বর ৯। হালেমার বি ব্লকের ১১ নম্বর লাইনে ৩ তলা বাড়ি রয়েছে। পিতার নাম আলম বাড়ি নম্বর-১।
এক পরিবারের একাধিক সদস্য যারা ফ্ল্যাট পেয়েছেন, তারা হলেন— বিএনপি নেত্রী রেহেনার পরিবারের ১৯ সদস্য, আকরামের পরিবারের ১২ জন, নজরুল ইসলাম নাঈম চেয়ারম্যানের পরিবারের ৪ জন, মোশারফের পরিবারের ৯ জন, বানেছার পরিবারের ৪ জন, সেন্টুর পরিবারের ৬ জন, জহিরের পরিবারের ৪ জন, রফিকের পরিবারের ৩ জন ও আলমগীরের পরিবারের ৩ জন।
জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ঢাকা অঞ্চল ১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী জোয়ারদার তাবেদুন নবী ওই দৈনিককে বলেন, ভাড়াভিত্তিক ৩০০ ফ্ল্যাটের মধ্যে ২৭২টি ফ্ল্যাটের ভাড়াপত্র হস্তান্তর করা হয়েছে। আমরা ভাড়াপত্র হস্তান্তর করেছি, এখনও কারও সঙ্গে চুক্তি করিনি। তালিকা করতে গিয়ে কিছু ভুলভ্রান্তি হয়েছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই চলছে। তালিকা আপগ্রেড হচ্ছে। কিছু অভিযোগ এসেছে। তদন্ত চলছে। ভাড়াপত্র যারা পেয়েছেন, তাদের কেউ ব্যাচেলর, মাদকসেবী ও বাড়ির মালিক হলে বাদ দেওয়া হবে।
বস্তিবাসীদের জন্য যে জায়গায় পাঁচটি ভবন হয়েছে, সেখানেও আগে বস্তি ছিল। ২০১৮ সালের জুন মাসে এসব ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়। গত ডিসেম্বরে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। করোনার কারণে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় দুটিই বেড়েছে। প্রথমে ব্যয় ধরা হয় প্রায় ১০০ কোটি টাকা। পরে ব্যয় বেড়ে হয় ১৩১ কোটি টাকা। মেয়াদ বাড়ানো হয় এ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। পাচটি ভবনে মোট ফ্ল্যাট হবে ৫৩৩টি। এর মধ্যে ৬৫টি ফ্ল্যাট ৭২০ বর্গফুটের (কমন স্পেসসহ)।
প্রথম তিনটি ভবনের নির্মাণকাজ শেষের পর ফ্ল্যাটের বরাদ্দ দিয়েছে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। ভবন নির্মাণের জন্য বস্তির যেসব বাসিন্দা উচ্ছেদ হয়েছেন, তারা ফ্ল্যাট বরাদ্দের তালিকায় অগ্রাধিকার পেয়েছেন। এ ছাড়া মিরপুরের বিভিন্ন বস্তির বাসিন্দারাও এই তালিকায় রয়েছেন। তালিকা তৈরির কাজে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সহায়তা নিয়েছে।
বস্তিবাসীর জন্য ভাড়াভিত্তিক ফ্ল্যাট প্রকল্পের উদ্বোধন ও হস্তান্তর করা হয় ৩ আগস্ট। ওই দিনই ৩০০ বস্তিবাসীর হাতে ফ্ল্যাটের সাময়িক ‘ভাড়াপত্র’ তুলে দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটা প্রকল্প ঘিরেই নানা রকম দুর্নীতি অনিয়মের মহোৎসব চলে। প্রকল্পকে কেন্দ্র করে এমন কোনো সুযোগ নেই যা দুষ্কৃতিকারীরা হাতছাড়া করতে চান। বস্তিবাসীর ফ্ল্যাট বরাদ্দে ভবন মালিকেরা বরাদ্দ নিতে লাফিয়ে পড়েছেন যা অত্যন্ত লজ্জাজনক ব্যাপার। তারা ভেবেছিলেন ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেলেই এর মালিকানা পাওয়া যাবে। তাই সবাই ফ্ল্যাট নেওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন। অনেকে টাকার বিনিময়ে কিংবা লবিং করে ফ্ল্যাট বাগিয়েছেন। কতটা নির্লজ্জ হলে পরে তারা এসব করতে পারেন! এবিষয়ে কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হাত রয়েছে বলে দাবি করেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, সরকারি প্রকল্প ঘিরে যেন সরকারের লোকজন থেকে শুরু করে প্রকল্পের লোকজনও ওঁত পেতে থাকেন বিভিন্ন অবৈধ সুযোগ সুবিধার জন্য। যে যেদিক দিয়ে পারে সেদিকটাই লুফে নেন। এবিষয়ে সরকারের তেমন কোনো মাথা ব্যথাও লক্ষ্য করা যায় না। বস্তিবাসীর ফ্ল্যাট ভাড়ায় বরাদ্দের অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ কামনা করেন বিশেষজ্ঞরা। একইসাথে এরসাথে জড়িত ব্যক্তিদের ও ভবন মালিকদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির দাবি করেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫৭
আপনার মতামত জানানঃ