রাজধানীর গুলশানে কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার (২১) ‘আত্মহত্যা প্ররোচণার’ মামলায় বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পায়নি পুলিশ। সে কারণে কলেজছাত্রী মুনিয়ার ‘আত্মহত্যায় প্ররোচনার’ মামলা থেকে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত।
মামলায় পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দে’য়া হয়। আজ বুধবার (১৮ আগস্ট) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরী এ আদেশ দেন।
বসুন্ধরা এমডির সম্পৃক্ততা পায়নি পুলিশ
প্রায় তিন মাস পর আদালতে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় গুলশান থানার পুলিশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, আত্মহত্যা প্ররোচনায় বসুন্ধরার এমডির কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।
গত ১৯ জুলাই গুলশানে কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার আত্মহত্যার ঘটনায় সায়েম সোবহান আনভীরের প্ররোচণায় সম্পৃক্ততা না পাওয়ার কথা উল্লেখ করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে গুলশান থানা পুলিশ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী সে সময় বলেছিলেন, “মুনিয়ার আত্মহত্যা প্ররোচনা মামলায় বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। তাই চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।”
মঙ্গলবার ঢাকার মহানগর হাকিম রাজেশ চৌধুরীর আদালতে ওই প্রতিবেদন নিয়ে আপত্তি জানিয়ে অন্য কেনো সংস্থার মাধ্যমে মামলাটি তদন্তের আবেদন করেন বাদী নুসরাত জাহান তানিয়া। এ দিন সকালে মামলার বাদী নুসরাত জাহান তানিয়ার পক্ষে আইনজীবী মাসুদ সালাউদ্দিন চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন দাখিল করেন।
ওই আবেদনের ওপর শুনানি শেষে বিচারক নথি পর্যালোচনায় আদেশের জন্য রাখেন। পরে বুধবার বিকেলে নারাজির আবেদন নাকচ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে আদেশ দেন আদালত। আদেশে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
মামলার এজাহারে যা উল্লেখ ছিল
মুনিয়া মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী। দুই বছর আগে মামলার আসামি সায়েম সোবহান আনভীরের (৪২) সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরিচয়ের পর থেকে তারা বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় দেখা করতেন এবং সব সময় মোবাইলে কথা বলতেন। একপর্যায়ে দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
২০১৯ সালে মুনিয়াকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে আসামি রাজধানীর বনানীতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। সেখানে তারা বসবাস করতে শুরু করেন। ২০২০ সালে আসামির পরিবার এক নারীর মাধ্যমে এই প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি জানতে পারে।
এরপর আসামির মা মুনিয়াকে ডেকে ভয়ভীতি দেখান এবং তাকে ঢাকা থেকে চলে যেতে বলেন। আসামি কৌশলে মুনিয়াকে কুমিল্লায় পাঠিয়ে দেন এবং পরে বিয়ে করবেন বলে আশ্বাস দেন। সবশেষ গত ১ মার্চ মুনিয়াকে প্ররোচিত করেন আসামি। তিনি বাসা ভাড়া নিতে বাদী নুসরাত ও তার স্বামীর পরিচয়পত্র নেন।
তিনি মুনিয়াকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। গুলশানের ১২০ নম্বর সড়কে বাসা (ফ্ল্যাট-বি-৩) ভাড়া নেন। ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে আসামি ও মুনিয়া স্বামী-স্ত্রীর মতো ছবি তুলে তা বাঁধিয়ে রাখা হয়। আসামি বাসায় এলে কক্ষটি পরিপাটি করে রাখা হতো।
বোনের মাধ্যমে মামলার বাদী নুসরাত জানতে পারেন, আসামি মুনিয়াকে বিয়ে করে বিদেশে স্থায়ী হবেন। কারণ দেশে থাকলে আসামির মা–বাবা আসামিকে কিছু না করলেও তাঁর বোনকে মেরে ফেলবেন। গত ১ মার্চ থেকে আসামি মাঝেমধ্যে ফ্ল্যাটে আসা-যাওয়া করতেন।
এরপর গত ২৩ এপ্রিল মুনিয়া তাকে ফোন করে বলেন, আনভীর তাকে বকা দিয়েছেন। বলেছেন, কেন তিনি (মুনিয়া) ফ্ল্যাটের মালিকের বাসায় গিয়ে ইফতার করেছেন, ছবি তুলেছেন। ফ্ল্যাটের মালিকের স্ত্রী ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেছেন। এ ছবি ফ্ল্যাট মালিকের স্ত্রীর বান্ধবী পিয়াসা দেখেছেন। তিনি আসামির মাকে সবকিছু জানিয়ে দেবেন।
আসামি মুনিয়াকে বলেন, তিনি দুবাই চলে যাচ্ছেন, সে যেন কুমিল্লায় চলে যায়। আসামির মা জানতে পারলে তাকে (মুনিয়া) মেরে ফেলবেন। দুদিন পর গত ২৫ এপ্রিল মুনিয়া নুসরাতকে ফোন করেন। ওই সময় তিনি কান্নাকাটি করে বলেন, আনভীর তাকে বিয়ে করবেন না, শুধু ভোগ করেছেন।
আসামিকে উদ্ধৃত করে মুনিয়া বলেন, আসামি তাকে বলেছেন, তিনি (মুনিয়া) তার শত্রুর সঙ্গে দেখা করেছেন। মুনিয়াকে তিনি ছাড়বেন না। মুনিয়া চিৎকার করে বলেন, আসামি তাকে ধোঁকা দিয়েছেন। যে কোনো সময় তার বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তারা (বাদী নুসরাতের পরিবার) যেন দ্রুত ঢাকায় আসেন।
মামলার বাদী নুসরাত তার আত্মীয়স্বজন নিয়ে দুপুর ২টার দিকে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় রওনা দেন। আসার পথে বারবার মুনিয়ার ফোনে ফোন করেন, কিন্তু তিনি আর ফোন ধরেননি। গুলশানের বাসায় পৌঁছে দরজায় নক করলে ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নিচে নেমে আসেন।
তারা নিরাপত্তারক্ষীর কক্ষ থেকে বাসার ইন্টারকমে ফোন করেন। পরে ফ্ল্যাটের মালিকের নম্বরে ফোন দিলে মিস্ত্রি এনে তালা ভেঙে ঘরে ঢোকার পরামর্শ দেন। মিস্ত্রি ডেকে তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকার পর তিনি দেখেন, তার বোন ওড়না পেঁচিয়ে শোয়ার ঘরের সিলিংয়ে ঝুলে আছেন।
পুলিশ এসে ওড়না কেটে মুনিয়ার মৃতদেহ নামায়। আলামত হিসেবে আসামির সঙ্গে ছবি, আসামির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে লেখা ডায়েরি ও তার ব্যবহৃত দুটি মুঠোফোন নিয়ে যায় পুলিশ।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২১১২
আপনার মতামত জানানঃ