সিলেটের দক্ষিণ সুরমার জালালপুরের তিন মাদ্রাসাছাত্র একসঙ্গে ‘নিখোঁজ’ হয়েছে বলে জানিয়েছে তাদের পরিবার। গত ৩ আগস্ট থেকে তারা নিখোঁজ রয়েছে বলে তাদের পরিবারের সদস্যরা জানান। এই তিনজনই সিলেটের দক্ষিণ সুরমার জালালপুরের আল্লামা আব্দুল মুকিত মঞ্জলালী একাডেমির হিফজ শাখার ছাত্র।
সিলেট থেকে আব্দুর রাজ্জাক নামের এক কলেজ ছাত্র তালিবানদের হয়ে লড়তে আফগানিস্তানে যাওয়ার খবরের মধ্যেই এই তিন মাদ্রাসা ছাত্রের নিখোঁজ হওয়ার তথ্য জানা গেল।
নিখোঁজ তিনজনই কিশোর। তারা হলেন সাজ্জাদ মিয়া, রোহান আহমেদ, নাহিম আহমেদ। সাজ্জাদ দক্ষিণ সুরমার বলদি গ্রামের বাসিন্দা। রোহান দক্ষিণ সুরমার জালালপুরের করিমপুর গ্রামের নূরুল হকের ছেলে ও নাহিম একই এলাকার সমসপুর গ্রামের মৃত নলু মিয়ার ছেলে।
এদের মধ্যে সাজ্জাদ ও নাইম ৩ আগস্ট মাদ্রাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়। কিন্তু গত ৭ আগস্ট মাদ্রাসায় ফোন দিয়ে পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন, তারা মাদ্রাসায় যায়নি।
রোহান নামের আরেক মাদ্রাসা ছাত্রও নিখোঁজ বলে জানা যায়।
পরবর্তীতে নিখোঁজ কিশোরদের পরিবারের সদস্যরা তাদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেখানেও তাদের খুঁজে পাওয়া না গেলে তারা থানায় যোগাযোগ করেন।
গত ৮ আগস্ট সাজ্জাদ মিয়ার বোন দক্ষিণ সুরমা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডি এন্ট্রি নং-৩৩০, তাং-০৮/০৮/২০২১। অন্য দুই কিশোরের পরিবার জিডি করতে চাইলে মাদ্রাসা থেকে তাদের জিডি করতে নিষেধ করা হয় বলে জানান তাদের পরিবারের সদস্যরা।
নিখোঁজ সাজ্জাদের বোন রাশেদা বেগম বলেন, আমার ভাইটি সহজ সরল। তার কাছে কোনো মোবাইল ফোন নেই। গত ৩ আগস্ট রোহানের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে সে মাদ্রাসায় যায়। কিন্তু মাদ্রাসার হুজুর বলছেন, তারা মাদ্রাসায় যায়নি। এরপর থেকে তাকে আমরা সব আত্মীয় স্বজনের বাসায় খোঁজ নিয়েছি। কিন্তু তার কোনো খোঁজখবর পাইনি।
রোহান আহমেদের বাবা নূরুল হক বলেন, মাদ্রাসা থেকে হুজুর কল দিয়ে বলেছেন রোহান মাদ্রাসায় নেই। সে বাড়িও আসেনি। থানায় জিডি করতে গিয়েছিলাম কিন্তু হুজুর বলেছেন, তারা জিডি করেছেন। আমি গ্রামের মানুষ এত কিছু বুঝি না। সম্ভব সব জায়গায় খোঁজ করেছি কিন্তু রোহানকে পাইনি। শুনেছি তার সাথে আরও দুইটি ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না।
নিখোঁজ নাহিমের মামা আনোয়ার হোসেন বলেন, রোহানের সাথে নাহিমও মাদ্রাসায় গিয়েছিল। কিন্তু পরে মাদ্রাসার হুজুর বলেন তারা যায়নি। এরপর অনেক জায়গায় খোঁজ করেছি কিন্তু পাচ্ছি না। ছেলেটার বাবা নেই। মা একা কিছু করতে পারছেন না। এই অবস্থায় কী করবো কিছু ভেবে পাচ্ছি না।
এ ব্যাপারে দক্ষিণ সুরমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, সাজ্জাদ মিয়া নামে একটি ছেলে নিখোঁজের জিডি হয়েছে। তার সাথে আরও দুটি ছেলে আছে বলে জানা গেছে। তারা একটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করলেও বার বার এটা সিম বদলাচ্ছে। তারা তিনজন হয়তো পরিকল্পনা করেই গেছে। শেষ মোবাইল ট্র্যাক করে তাদের লোকেশন ময়মনসিংহের দিকে পাওয়া গেছে। আশা করি তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে।
তিনি বলেন, এভাবে তিনজন ছাত্র নিখোঁজের ব্যাপারটা আসলেই উদ্বেগজনক। কারণ সম্প্রতি তালেবান ইস্যুতে বাংলাদেশের কিশোর-যুবকদের সম্পৃক্ততার খবর পাওয়া গেছে। তবে আমরা এই ব্যাপারটা সিরিয়াসলি দেখছি।
তিনি বলেন, এর আগেও এই এলাকার এক মাদ্রাসা থেকে ছাত্র নিখোঁজ হলে আমরা তাদের গোয়াইঘাট থেকে উদ্ধার করি। তাদেরও উদ্ধারে সব ধরনের চেষ্টা চলছে।
সিলেট থেকে আব্দুর রাজ্জাক নামের এক কলেজ ছাত্র তালিবানদের হয়ে লড়তে আফগানিস্তানে যাওয়ার খবরের মধ্যেই এই তিন মাদ্রাসা ছাত্রের নিখোঁজ হওয়ার তথ্য জানা গেল।
এ ব্যাপারে ওই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক হাফিজুর রহমান বলেন, নিখোঁজ তিনজনই আমাদের মাদ্রাসার আবাসিক শিক্ষার্থী। এরমধ্যে দুজন ছুটিতে ছিলে। রোহান মাদ্রাসায় ছিলে। ৩ আগস্ট ক্লাস শেষে সবার অজান্তে রোহান মাদ্রাসা থেকে চলে যায়। এরপর জানতে পারি আরও দুই ছাত্র নিখোঁজ। এ ব্যাপারে আমরা থানায় জিডি করেছি। পুলিশ তাদের খুঁজছে।
পুলিশের জঙ্গিবিরোধী বিশেষ শাখা কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ (সিটিটিসি) রোববার জানিয়েছে, আব্দুর রাজ্জাক নামে সিলেটের মদনমোহন কলেজের এক ছাত্র তালিবনাদের হয়ে লড়তে আফগানিস্তান চলে গেছেন। ‘বন্ধুর বাড়িতে যাওয়ার’ কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আফগানিস্তান চলে যান রাজ্জাক। রাজ্জাকের আফগানিস্তান যাওয়া নিয়ে আলোচনার মধ্যেই সিলেটের আরও তিন ছাত্র নিখোঁজের খবর এলো।
এর আগে তালিবানের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দিতে বাংলাদেশের অনেকেই হিজরত করেছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আফগান যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তালিবানদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তারা হিজরত করেছে।’
শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্ব এখন সাইবার ওয়ার্ল্ড এর মধ্যে বন্দি। নিজেদের বাড়ি ঘর থেকে শুরু করে অফিস-আদালতে মিটিং করছি বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে। জঙ্গিরাও কিন্তু বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে তাদের মানুষের রিক্রুট করছে। সম্প্রতি আফগানিস্তানের যুদ্ধে যাওয়ার জন্য একটি আহ্বান জানানো হয়েছে তালিবানের পক্ষ থেকে। বাংলাদেশের কিছু মানুষ অলরেডি তালিবানের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য হিজরত করেছে। আমরা ধারণা করছি, কিছু মানুষ ভারতে ধরা পড়েছে, আর কিছু মানুষ পায়ে হেঁটে বিভিন্নভাবে আফগানিস্তানে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। সাইবার ওয়ার্ল্ডয়ে শুধু আমরা না, বিভিন্ন সংস্থা তাদের কার্যক্রমের মনিটর করে। যখনই সন্দেহজনক কোনও কিছু পাওয়া যায়, তখনই আমাদের অবহিত করে।। সরকারের সবাই তৎপর রয়েছে।’
এদিকে গতকাল রোববার দেশটির রাজধানী কাবুল দখলে নেওয়ার পর তালিবানের দখলে চলে যায় আফগানিস্তান। তালিবানের অধীনে আজ সোমবার আফগানদের জন্য প্রথমদিন। অনেক আফগানের জন্য দিনটি শুরু হয়েছে ভয়, উদ্বেগ, আতঙ্ক এবং কাবুল ছাড়ার তাড়া নিয়ে। এদিকে তালিবানের আফগানিস্তান দখল নিয়ে দেশেও চলছে নানা উত্তেজনা।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশের কিছু ধর্মান্ধগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক। ২০ বছর আগে যখন তালিবানের রমরমা অবস্থা ছিল, তখন এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বাংলাদেশ থেকে আফগানিস্তানে গিয়ে তালিবানে যোগ দিয়েছিল। একই সঙ্গে ঢাকার বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে স্লোগান দিয়ে বলেছিল, ‘বাংলা হবে আফগান, আমরা হব তালিবান’। তালিবান ফের আফগান মসনদে আসায় বাংলাদেশের ওই ধর্মান্ধগোষ্ঠী বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে— এমনই আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। কাজেই আফগান নিয়ে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থানে থাকতে হবে পরামর্শ তাদের।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১৫
আপনার মতামত জানানঃ