খুলনায় বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাকের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বাড়ছে। দৈনিক গড়ে ৪ টি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে খুলনা সিটি করপোরেশন এলাকায়। ফুটফুটে সন্তান ও মধুর সম্পর্কের স্মৃতি কোন কিছুই আটকাতে পারছে না বিচ্ছেদ।
তবে, বদলে গেছে তালাকের ধরণ। আগে শতকরা ৭০ ভাগ তালাকের ঘটনা স্বামী কর্তৃক ঘটলেও এখন বিচ্ছেদে এগিয়ে রয়েছে নারীরা। গত ১০ বছরে খুলনা সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৫ হাজার ৫০৯ টি তালাক রেকর্ড হয়েছে। সংখ্যার অনুপাত বিশ্লেষণে শতকরা এখন ৭০ ভাগ নারীরা তাদের স্বামীদের তালাক দিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ১০ বছরে খুলনায় ১৫ হাজার ৫০৯ টি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে ১৭২৭, ২০১৯ সালে ১৭০৬, ২০১৮ সালে ১৭১৯ ও ২০১৭ সালে ১৫৯৫ টি এবং চলতি বছরের ১২ আগষ্ট পর্যন্ত ৯৬৬ টি তালাক খুলনা সিটি করপোরেশনে রেকর্ড হয়েছে। এছাড়া ২০১১ সালে ১০৭৪, ২০১২ সালে ১১৮১, ২০১৩ সালে ১২৫৪, ২০১৪ সালে ১৪১৯, ২০১৫ সালে ১৪০৪, ২০১৬ সালে ১৪৮৭ টি তালাকের ঘটনা ঘটেছে।
খুলনার মনোবিজ্ঞানী ও সামাজিক অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়ার পিছনে ভারতীয় সিরিয়ালে আসক্তি, যৌথ পরিবার প্রথা বিলুপ্ত, মাদক, যৌতুক ও নারী নির্যাতনসহ ১০ টি কারণ চিহ্নিত করেছেন।
খুলনার মানবাধিকার কর্মী ড. মাহবুব আলম বলেন, বিবাহ বিচ্ছেদ বৃদ্ধির নেপথ্যে অনেক কারণ রয়েছে। তবে মূল কারণগুলোর তালিকা খুব বেশি বড় নয়। মোটামুটি ১০ টি কারণ আমরা চিহ্নিত করেছি।
সেগুলো হলো, ভারতীয় সিরিয়াল গুলোতে পরকীয়া, অবাধ্যতা ও উশৃংখলতা প্রদর্শন যা এদেশের নারী পুরুষের বড় একটি অংশকে ভুল পথে ধাবিত করছে। এছাড়া, যৌথ পরিবার প্রথা বিলুপ্ত, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে পারষ্পরিক অবিশ্বাস, পরকীয়া, দারিদ্র্য আবার ক্ষেত্র বিশেষে অধিক ধনশালী হয়ে বেপরোয়া জীবন যাপন, মাদকাদক্তি, সন্তান না হওয়া, নারী নির্যাতন ও যৌতুক, বহু বিবাহের প্রবনতা এবং মানসিক ও শারিরিক অসুস্থতা। সর্বোপরি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে না চলাও পারিবারিক অশান্তি ও বিশৃংখলার অন্যতম কারণ।
খুলনা আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের চিকিৎসক ও সমাজকর্মী ডা. সুদেব মন্ডল বলেন, এখন কোন কারনে দাম্পত্য জীবনে ভুল বুঝাবুঝি হলেই বিবাহ বিচ্ছেদকে অনেকেই সমাধান মনে করছেন। পারিবারিক ভাবে এ ধরণের সমস্যা গুলো সমাধান করার প্রবনতা অনেক কমে গেছে।
অভিভাবকরাও ক্ষেত্র বিশেষে সন্তানদের সংসার জোড়া লাগার বদলে বিচ্ছেদকেই একমাত্র পথ মনে করে থাকেন। মানুষের মধ্যে আগের মতো ধৈর্য্য ও সহনশীলতা নেই। মেনে চলা ও মানিয়ে চলার প্রবনতা কমে যাওয়ায় বাড়ছে তালাক।
খুলনা জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান সাজ্জাদুর রহমান লিংকন বলেন, সামাজিক ভাবে যত সালিসি বিচার আচার করা হয়, তার মধ্যে পারিবারিক অমিল ও দাম্পত্য কলহ বিষয়ক অভিযোগ বেশি আসে। আমরা চেষ্টা করি যতটা সম্ভব বিবাহ বিচ্ছেদ এড়িয়ে চলার। তারপরও দেখা যায়, অভিযোগকারীরা শুরুতেই সংসার করবেন না এমন সিদ্ধান্তই যেন নিয়ে আসেন।
উচ্চ ও নিম্নবিত্ত পরিবারে এ বিচ্ছেদের হার অনেক বেশি। তবে নারীদের কাছ থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন বেশি আসলেও নারীরাই বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছেন। পাশাপাশি এর প্রভাব পড়ছে সন্তানের উপর। তারা বেড়ে উঠছে ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান হিসেবে। যা তাদের স্বাভাবিক মানসিক বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে। তারা এক ধরনের আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগে। তাদের জীবন হয়ে ওঠে অস্বাভাবিক।
সমাজ, পরিবারকে নেতিবাচক হিসেবে দেখে। তাদের মধ্যে জীবন বিমুখতা তৈরি হয়। পারিবারিক অশান্তি, হতাশা ও অপরাধমূলক কাজের প্রবণতায় অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তৈরি হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪৩৭
আপনার মতামত জানানঃ