ঋণের জন্য এক্সিম ব্যাংকের দুই কর্মকর্তাকে অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যা চেষ্টার অভিযোগে দায়ের করা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন থেকে সিকদার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রন হক সিকদার ও তার ভাই দিপু হক সিকদারের নাম বাদ দিয়েছে পুলিশ।
তদন্ত কর্মকর্তা ও পুলিশের গোয়েন্দা শাখার উপ-পরিদর্শক মো. রিপন উদ্দিন গত ২৯ জুলাই ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। সেখানে বলা হয়েছে, উভয় পক্ষই আদালতের বাইরে বিষয়টি নিষ্পত্তি করেছেন।
সিকদার গ্রুপের দুই আলোচিত ভাই রন হক সিকদার ও দিপু হক সিকদারের বিরুদ্ধে করা হত্যাচেষ্টা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান জোনাল টিম জানায়, একটি ভুল বোঝাবুঝির প্রেক্ষিতে অত্র মামলার উদ্ভব হয়, কিন্তু পরবর্তীতে বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষ নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন এবং নিজেদের অত্র মামলার ঘটনার বিষয়ে একটি ‘সমঝোতা চুক্তি’ করেন। যাতে তারা উল্লেখ করেন যে, তারা তাদের পূর্বের ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে পরস্পরের সাথে সম্মানের সহিত ব্যবসায়িক সর্ম্পক এগিয়ে নিয়ে যেতে চান।
দায়েরকৃত মামলার ফলাফল মেনে নিয়ে এ বিষয়ে তারা পরবর্তীতে কোন আইনি পদক্ষেপ নিবে না বলে জানান। বর্তমানে উভয়পক্ষ পূর্বের ন্যায় তাদের একে অপরের সহযোগিতায় ইতিবাচক ব্যবসা ও ব্যাংকিং সম্পর্ক চালিয়ে আসছে।
আলোচিত মামলাটির তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা ছিলেন পরীমণি কাণ্ডে আলোচনায় আসা ও বদলি হওয়া অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার গোলাম সাকলায়েন শিথিল।
রিপোর্টে শিথিল উল্লেখ করেন, “এজাহারে উল্লেখ করা আসামি রন হক সিকদার (৪৮) ও দিপু হক সিকদার (৫৩)— দুজনের বিরুদ্ধে পেনাল কোড আইনের হত্যাচেষ্টা অভিযোগসহ, ৩০৭, ৩৬৫ ও ৩৮৪ ধারায় আনা অভিযোগে অভিযুক্ত করার মত কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। এছাড়া ভুল বোঝাবুঝির কারণে অত্র মামলার উদ্ভব হয়েছে। বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষ নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে এবং তারা তাদের মধ্যে ইতিপূর্বে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে পরস্পরের সাথে সম্মানের সহিত ব্যবসায়িক সম্পর্কে এগিয়ে যেতে চায় এবং দায়েকৃত মামলার ফলাফল মেনে নিয়েই এ বিষয়ে পরবর্তীতে কোন আইনি পদক্ষেপ নিবে না মর্মে সমঝোতা চুক্তি করেছেন।
আমি মামলার তদন্তের ফলাফল নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে তাদের মৌখিক মতামত গ্রহণ করে মামলাটি অহেতুক মুলতবি না রেখে দুইজন আসামিকে এই মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিতে আবেদনসহ এই মামলার বিজ্ঞ আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করছি। একই সাথে মামলাটি ‘তথ্যগত ভুল’ বলে প্রতীয়মান হওয়ায় আসামি রন হক সিকদার ও দিপু হক সিকদার— দুইজনকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে অনুরোধ করছি।”
গত ২৭ জুলাই মামলার জব্দ করা আলামত বিলাসবহুল গাড়ি, পিস্তল ও গুলি আসামিদের কাছে ফেরত দিতে আদালতের কাছে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান জোনাল টিমের উপ-পরিদর্শক মো. রিপন উদ্দিন।
মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তদন্তকারী কর্মকর্তা আরো জানান, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আসামি রন হক সিকদারের দেয়া তথ্যে বনানী থানা এলাকার ১১ নম্বর রোডের ২৬ নম্বর সিকদার হাউসের আটতলায় রন হক সিকদারের বেডরুমে ওয়্যারড্রোবের ড্রয়ার থেকে একটি লাইসেন্স করা পিস্তল ও দুটি খালি ম্যাগাজিন ও ৭০ রাউন্ড গুলি জব্দ করা হয়। এরপর গত ০৭ মে ২০২০ তারিখে পিস্তলটি থেকে কোন ফায়ার হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করতে বিশেষ পুলিশ সুপার, ফরেনসিক (সিআইডি) এর কাছে পাঠানো হয়। পিস্তলটির ব্যালাস্টিক পরীক্ষায়, একে একটি স্ট্যান্ডার্ড পিস্তল, ফায়ারআর্মস বলে উল্লেখ করা হয়। পরে চলতি বছরের ১৫ মার্চ এক প্রতিবেদনে সিআইডি জানায় রাসায়নিক পরীক্ষায় পিস্তলটির ব্যারেলে ফায়ার চিহ্ন পাওয়া যায়নি। গত ৭ মে, ২০২০ তারিখে ফায়ার করা হয়েছে কিনা তা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়, যা পর্যালোচনা করতে সিআইডির ব্যালাস্টিক ও রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন আদালতে প্রেরণ করা হয়।
এছাড়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে পুলিশ জানায়, এজাহারভুক্ত জামিনে থাকা আসামি রন হক সিকদার ও ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের ব্যাবস্থাপনা পরিচালকসহ গত ৭ মে, ২০২০ তারিখে এক্সিম ব্যাংক গুলশান সিম্ফনি ভবনে গিয়ে ব্যাংকটির এএমডি ও এমডি মহোদয়কে উল্লেখিত ঠিকানা থেকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে থাকলে সে বিষয়ে এক্সিম ব্যাংকের সিসিটিভি ফুটেজ ও আসামি রন হক সিকদার এক্সিম ব্যাংক হতে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়া প্রস্তাব বিষয়ে কাগজপত্রের সত্যায়িত কপি প্রেরণের জন্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এক্সিম ব্যাংক বরাবর আলাদা আলাদা চিঠি পাঠানো হয়। চলতি বছরের ০৮ জুন দুটি চিঠিতে জবাব দিলেও ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার বিষয়ে এক্সিম ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোন কাগজপত্র প্রদান করতে পারে নাই।
এছাড়া ৭ মে, ২০২০ তারিখের সিসিটিভি ভিডিও ফুটেজ গত ১৪ জুন ২০২০ তারিখে সরবরাহ করা হয়, যাতে অভিযোগে উল্লেখ করা তারিখে আসামি রন হক সিকদার ও দিপু হক সিকদারের এক্সিম ব্যাংকের গুলশান সিম্ফনি ভবনে উপস্থিতি দেখা যায়নি।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, চলতি বছরের ২০ জুলাই এক্সিম ব্যাংকের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ মনিরুল ইসলামের স্বাক্ষর করা একটি চিঠিতে ৩০০ টাকা নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে সমঝোতা চুক্তিতে বলা হয়, অত্র মামলার বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষের সাক্ষীদের উপস্থিতিতে একটি সমঝোতা চুক্তি করেন এবং তারা জানান যে, ভুল বোঝাবুঝির কারণে বাদীপক্ষ বিবাদীদের বিরুদ্ধে অত্র মামলাটি দায়ের করেন।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর রন হককে গ্রেপ্তার করা হয়। বাবার মৃত্যুর পর সেদিন তিনি দুবাই থেকে ফিরে আসেন। একই দিন সিএমএম আদালতে হাজির করা হলে তাকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেওয়া হয়।
গত বছরের ১ মে এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া ও অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেনকে নির্যাতন, হত্যা চেষ্টার অভিযোগে ব্যাংকের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সিরাজুল ইসলাম সিকদার গ্রুপের রন ও দিপুর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
মামলার বিবৃতি অনুযায়ী, ৫০০ কোটি টাকার ঋণের জন্য বন্ধক রাখা দুই ভাইয়ের সম্পত্তির মূল্য বাড়িয়ে দিতে অস্বীকার করায় ওই ব্যাংকের দুই শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর হামলা চালানো হয়।
এতে আরও বলা হয়েছে, ব্যাংক কর্মকর্তাদের বনানীর একটি বাড়িতে আটকে রেখে দুই ভাই নির্যাতন করেন এবং অস্ত্রের মুখে তাদের সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন।
তোর কত বড় সাহস যে আমার কথা অমান্য করিস। গুলি করে জন্মের মতো খোঁড়া করে দিব,’ বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়াকে অস্ত্রের মুখে ধরে এনে এভাবেই হুমকি দিয়েছেন সিকদার গ্রুপের এমডি রন হক সিকদার।
শুধু তাই নয়, ব্যাংকটির এমডি ও অতিরিক্ত এমডি মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেনকে গুলি করে হত্যার চেষ্টাও করেন তারা। চালানো হয় নির্যাতন। জোর করে সাদা কাগজে সইও নেওয়া হয়।
মামলা নথিভুক্ত হওয়ার ছয় দিন পর গত বছরের ২৫ মে দুই ভাই সরকারি অনুমতি নিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ব্যাংককে পালিয়ে যান।
একই বছরের ২০ জুলাই এই মামলায় বিদেশ থেকে আগাম জামিনের জন্য আবেদন করায় হাইকোর্ট রন ও তার ভাইকে জরিমানা করেন।
তাদের জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যান করে হাইকোর্টের একটি ভার্চুয়াল বেঞ্চ দুই সপ্তাহের মধ্যে জরিমানা হিসেবে কোভিড-১৯ মহামারি রোধে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে প্রত্যেককে পাঁচ হাজার ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন।
তহবিলে পিপিই দেওয়ার পর দুই ভাইকে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২১
আপনার মতামত জানানঃ