করোনাকালে ঘরে থাকা শিশুদের ক্ষীণদৃষ্টি অথবা দূরে দেখার ক্ষমতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন গবেষকরা। সমস্যাটির নাম মায়োপিয়া। গবেষকরা বলছেন, করোনার সময় ঘরে আটকে থাকা শিশুদের দৃষ্টিশক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দূরের বস্তু পরিষ্কার দেখতে পাওয়ার ক্ষমতা হারাচ্ছে তারা।
হংকংয়ের দ্য চায়নিজ ইউনিভার্সিটি অফ হংকং-এর একদল গবেষক দেড় বছরের বেশি সময় গবেষণা চালিয়ে এমন উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশ করেছেন। তাদের নিবন্ধটি ব্রিটিশ জার্নাল অফ অফথমলজিতে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষকরা গত বছর ৬ থেকে ৮ বছর বয়সী ৭০৯ শিশুকে পর্যবেক্ষণ করে অনেকের মধ্যেই হ্রস্বদৃষ্টি বা মায়োপিয়ার লক্ষণ দেখতে পান। এ ধরনের শিশুরা কাছের বস্তুকে ভালোভাবে দেখতে পেলেও দূরের বস্তু ছিল ঘোলাটে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালের তুলনায় করোনার প্রথম বছরে শিশুদের মায়োপিয়ায় আক্রান্তের হার বেড়েছে ১০ শতাংশ।
গবেষকরা বলছেন, মহামারির সময়ে শিশুদের জীবনযাপনে পরিবর্তন আসায় মায়োপিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। তারা বাড়ির বাইরে যেতে পারছে না। পাশাপাশি দিনভর ঘরের ভেতরে ডিজিটাল মাধ্যমে আসক্তি, আঁকাআঁকি, বই পড়ার মতো কাজ করায় ‘হ্রস্বদৃষ্টি’ তৈরি হচ্ছে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, মায়োপিয়ার ক্ষেত্রে জিনগত কারণের চেয়ে বেশি দায়ী ঘরের বাইরে না যাওয়া। ঘরের মধ্যে দীর্ঘদিন আটকে থাকলে মানুষের চোখ দূরের বস্তুকে দেখার জন্য প্রয়োজনীয় অভিযোজন ক্ষমতা হারাতে থাকে।
হংকংয়ের গবেষকরা তাদের নিবন্ধে লিখেছেন, ‘মহামারির বিস্তার ঠেকাতে ঘরে থাকার বাধ্যবাধকতা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার মতো ব্যবস্থা চিরদিন থাকবে না, তবে এই সময়ে ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্তিসহ মানুষের জীবনযাপনে যে পরিবর্তন ঘটছে, তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সবার জীবনে, বিশেষ করে শিশুদের ওপর থাকবে।’
আধুনিক জীবনে বিভিন্ন দেশেই মায়োপিয়া উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীনের ৯০ শতাংশের মতো মানুষ হ্রস্বদৃষ্টির সমস্যায় আক্রান্ত, এ কারণে দেশটিতে মায়োপিয়াকে মহামারি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
আধুনিক জীবনে বিভিন্ন দেশেই মায়োপিয়া উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীনের ৯০ শতাংশের মতো মানুষ হ্রস্বদৃষ্টির সমস্যায় আক্রান্ত, এ কারণে দেশটিতে মায়োপিয়াকে মহামারি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
চীনে পরিচালিত এক গবেষণায় করোনাকালে শিশুদের মধ্যে এ সমস্যা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা উঠে এসেছে। আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মেডিকেল জার্নাল জ্যামা অফথালমোলজিতে গত ১৪ জানুয়ারি প্রকাশিত ‘২০২০-এ ইয়ার অব কোয়ারেন্টিন মায়োপিয়া’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনে ছয় থেকে আট বছর বয়সী শিশুদের মায়োপিয়ার হার আগের চেয়ে ১ দশমিক ৪ থেকে ৩ গুণ বেড়েছে।
চীনের শ্যানডং প্রদেশের ফেইচাং এলাকার ১০টি এলিমেন্টারি (প্রাথমিক) স্কুলের ৬ থেকে ১৩ বছর বয়সী ১ লাখ ২৩ হাজার ৫৩৫টি শিশুর ওপর তিয়ানজিন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে গবেষণাটি হয়। গবেষকেরা মহামারির সময়ের সঙ্গে আগের পাঁচ বছরের তুলনা করে মায়োপিয়া বাড়ার হার তুলে ধরেন। এতে আরও বলা হয়, ৯ থেকে ১৩ বছর বয়সী শিশুরা অনলাইনে বেশি সময় ধরে ক্লাস করলেও তাদের মায়োপিয়া বাড়ার হার কম।
বাংলাদেশে করোনাকালে মায়োপিয়া পরিস্থিতি জানতে একটি গবেষণা শুরু করেছে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু বিভাগ। গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে শুরু হওয়া গবেষণাটির শিরোনাম ‘কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ঘরবন্দী থাকার কারণে স্কুলের শিশুদের মায়োপিয়া’।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেকর্ড বই ঘেঁটে দেখা যায়, এ বছরের প্রথম ৪ মাসে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার শিশুর চোখের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালে সংখ্যাটি সাড়ে ৪৪ হাজার ছিল, যা আগের বছরের চেয়ে কম। চিকিৎসকেরা বলছেন, করোনাকালে খুব জরুরি না হলে কেউ হাসপাতালে আসেনি। এটাই রোগী কমার কারণ।
চিকিৎসকেরা বলছেন, মায়োপিয়ার সমস্যাটি চশমা ব্যবহারের মাধ্যমে সমাধান করা যায়। তবে শিশুরা যাতে এ সমস্যায় না পড়ে সেজন্য কিছু পরামর্শও দিয়েছেন তারা।
তারা বলেন, এই সময়ে অনলাইন ক্লাস যেহেতু বন্ধ করা যাবে না, তাই ক্লাসের পর যথাসম্ভব ডিজিটাল ডিভাইস বর্জন করতে হবে। এ ছাড়া ডিভাইস থেকে দূরে শরীর সোজা রেখে যথাযথভাবে বসতে হবে। তারা বলেন, একনাগাড়ে ডিভাইস ব্যবহারে মাথাব্যথা হয় ও চোখে চাপ পড়ে।
আরও বলেন, ডিভাইসের ব্যবহার চোখের দৃষ্টিতে প্রভাব ফেলতে পারে। গত এক বছরে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেওয়া শিশুদের মধ্যে যারা চশমা ব্যবহার করত, তাদের অনেকের চশমার ‘পাওয়ার’ পরিবর্তন হয়েছে বলে দেখা গেছে। তাদের মতে, অনলাইন ক্লাস চলার সময় ৩০ মিনিট পরপর ১০ মিনিটের জন্য চোখের বিশ্রাম দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা জরুরি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪৬
আপনার মতামত জানানঃ