জাতীয় সংসদে কম্পানি আইন সংশোধনের প্রস্তাব পাস হয়েছে। এতে করে এখন থেকে একজনকে পরিচালক করে ‘এক ব্যক্তি কম্পানি’ গঠনের সুযোগ সৃষ্টি হলো। আইনটি সংশোধনের সময় বিরোধীরা সংসদে দাঁড়িয়ে এর বিরোধিতা করেছে। অভিযোগ করেছেন যে, এর মাধ্যমে লুটপাটের পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে। সরকার অবশ্য বলছে, ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণের অংশ হিসেবে নেয়া হয়েছে এমন পদক্ষেপ। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দেশে বর্তমানে আইনপ্রয়োগের যে অবস্থা তাতে এর ফল খারাপ হওয়ার শঙ্কাই প্রবল।
সংসদে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা এক ব্যক্তির কম্পানি খোলার বিষয়ে উত্থাপিত বিলের কঠোর সমালোচনা করেন। তারা বলেন, এই আইনের মাধ্যমে এক পরিবারের একাধিক সদস্যকে একাধিক কম্পানি গঠন করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে অর্থ লুট করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হলো। বিদ্যমান আইনেই অনেকে কম্পানির নামে ঋণ নিয়ে বিদেশে গিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। নতুন করে কম্পানি আইনে এমন সংশোধনীর ফলে লুটপাটের সুযোগ আরও বাড়বে বলেই মত দেন তারা।
জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান বলেন, এর ফলে এক বাড়িতেই দশটা কম্পানি গড়ে ওঠে কিনা, এমন ভয় থেকে যায়। এক পরিবারের দশজন টাকা তুলে বিদেশ চলে যান কিনা সে শঙ্কাও আছে। দলটির আরেক নেতা শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেন, ‘এটা সহজ কাজ। সূচক বাড়বে কিন্তু সার্বিক ব্যবসার সূচক বাড়বে না। ব্যাংক থেকে অর্থ লুট বড় বাধা। কম্পানি খোলা হয়েছে কর্মচারীর নামে। পাঁচ জায়গায় লোন নেওয়া হয়েছে। এক লাখ কোটি টাকা লুট হচ্ছে। এখানে সতর্ক হওয়া উচিত। ব্যাংক সিন্ডিকেটের কম্পানি আছে, যারা ব্যাংক লোন নেয়। পরিবারের বিভিন্ন লোক লোন নিয়ে ফ্রড করে।’
১৮ নভেম্বর ২০২০, বুধবার ‘কম্পানি (দ্বিতীয় সংশোধন) বিল-২০২০’ সংসদে পাসের প্রস্তাব করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। বিরোধিতা সত্ত্বেও পরে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। গত ৭ সেপ্টেম্বর বিলটি সংসদে তোলার পর সেটি পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘ভারত-পাকিস্তানেও এই আইন আছে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডায় আছে। আন্তর্জাতিক কিছু বিনিয়োগ পাওয়া এ আইনের লক্ষ্য। এই আইন এখন সময়ের দাবি।’
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকার ফলাফলের বিষয়ে যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা না করেই এই কাজে হাত দিয়েছে। মূলত বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণ সূচকে অগ্রগতিই সরকারের লক্ষ্য। এটি মধ্যম আয়ের রাষ্ট্র গঠনসহ আন্তর্জাতিক নানা ফোরামে বাংলাদেশের মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বিধায় সরকার এখানে উন্নতি দেখতে চায়। এখন পর্যন্ত এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা খুবই শোচনীয়। সর্বশেষ হিসেবে আট ধাপ এগোলেও তা সন্তোষজনক নয়, কারণ একই সময়ে ভারত এগিয়েছে ৬৩ ধাপ। নেপাল ১৬ ধাপ, আর ২৮ ধাপ এগিয়েছে পাকিস্তান। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের পেছনে শুধু যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এক ব্যক্তি কম্পানি আইন ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য ভালো হলেও তদারকি না থাকলে এটা হয়ে উঠতে পারে বড় এক সমস্যা। আমাদের দেশে সরকারি প্রভাব বা প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ঋণ নেয়া, সম্পদ সংগ্রহ ও লোকবল নিয়োগের এমনসব পদ্ধতি চালু আছে, যা ঠিক প্রথাগত নিয়ম মেনে চলে না। অর্থাৎ সব চুক্তিতে দলিল থাকে না, নিয়োগ দিলেও নিয়োগপত্র দেয়া হয় না। সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে হিসাব বেশি বা কম দেখানো হয়, ঋণ নেয়া হয় প্রতারণা করে। ব্যবস্থাগত দুর্বলতার সুযোগেই এসব ঘটে। এরকম অবস্থায় এক ব্যক্তি কম্পানি এই সব সুযোগই নিতে পারবে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘সরকার ব্যবসা বাণিজ্য সহজীকরণের উদ্যোগ নিতে চায়। এই সুযোগে একটি সিন্ডিকেট এক ব্যক্তি কম্পানির বিধান পাস করিয়ে নিল। সারা বিশ্বে কিন্তু এক ব্যক্তি কম্পানির ইমেজ খারাপ না। কিন্তু আমাদের এখানে কী হবে, এটা সহজেই অনুমেয়। সাধারণ মানুষ যখন এটা করবে, সেটা সমস্যা না। তবে ক্ষমতাধররা এটাকে কাজে লাগিয়ে লুটপাট চালাতে পারে, অন্তত সেই সুযোগটা থাকছে।’
কম্পানি আইন অনুযায়ী এখন প্রাইভেট লিমিটেড কম্পানি পরিচালিত হয় পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে। এই পর্ষদ বা বোর্ডের পরিচালক ও চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। বিলে আনা সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘এক ব্যক্তির কম্পানি’ হলো সেই কম্পানি, যার বোর্ডে সদস্য থাকবেন কেবল একজন। বিলে বলা হয়েছে, এক ব্যক্তি কম্পানির পরিশোধিত শেয়ার মূলধন হবে অন্যূন ২৫ লাখ টাকা এবং অনধিক ৫ কোটি টাকা। সংসদে উত্থাপিত বিলে পরিশোধিত মূলধন অন্যূন ৫০ লাখ টাকা এবং অনধিক ১০ কোটি টাকা রাখা হয়েছিল। সংসদীয় কমিটি টাকার অঙ্ক সীমিত রাখার পক্ষে মত দিলে তা গৃহীত হয়।
এক ব্যক্তির কম্পানিকে বছরে কমপক্ষে একটি পরিচালক সভা করতে হবে বলে বিলে বিধান রাখা হয়েছে। পরিচালক এবং প্রধান ব্যক্তি একজন থাকেন বলে এ ধরনের কম্পানি পর্ষদ সভা করা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নিয়মের ছাড় পাবে। একমাত্র সদস্য মারা গেলে তার মনোনীত ব্যক্তি সকল শেয়ারের স্বত্ববান হবে বলে প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে। বিলে বলা হয়েছে, কম্পানি উঠে গেলে পাওনাদারদের ঋণ পরিশোধে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
মিই/আরা/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ