অর্থনীতি প্রতিবেদক : ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোতে এখন ভোট ছাড়াই নেতা হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আবার তারাই হচ্ছেন রাজনীতির মাঠে কাণ্ডারী। এদের মধ্যে কেউ কেউ হচ্ছেন সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, আবার কেউ কেউ হচ্ছেন সংসদ সদস্য থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত। এসব ব্যবসায়ী সংগঠনের ভোটে অনির্বাচিত নেতারাই হয়ে উঠেছেন দেশের রাজনীতির নীতি নির্ধারক। ভোট না করে যারা নেতা হচ্ছেন তাদের দ্বারা নির্বাচনী ব্যবস্থা কতটা সুরক্ষিরত রাখা সম্ভব, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
আইনী বাধ্যবাধকতা থাকলেও বছরের পর বছর ধরে নির্বাচন নেই বাণিজ্য সংগঠনগুলোর। ভোটবঞ্চিত সাধারণ ব্যবসায়ীরা সঠিক নেতা নির্বাচন করতে না পেরে হতাশ হয়ে উঠছেন। বাণিজ্য সংগঠনগুলোর ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচন করার অনাগ্রহের কারণে সংগঠনগুলো প্রাণচাঞ্চল্য ও প্রতিযোগিতাহীন হয়ে পড়েছে। এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, ডিসিসিআই, এমসিসিআই, বিকেএমইএ, বিটিএমএ, বিএবি এর মত বড় বড় ৩ শতাধিক সংগঠনের একই হাল। এসব ভোটবিহীন সংগঠনের নেতারাই যখন রাজনীতির কাণ্ডারী হন, তখন রাজনীতির মান নিম্নগামী হওয়াই স্বাভাবিক মানেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বাণিজ্যিক সংগঠনগুলোর ভোটবিহীন নেতা নির্বাচন প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এসব বাণিজ্যিক সংগঠনকে কিছু শর্তে নিবন্ধন দেওয়া হয়। নিবন্ধন শর্তানুযায়ী যদি ভোট করার কথা থাকে এবং তা না করা হলে – অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
ড. ইফতেখারুজ্জামান এর ভাষ্যমতে, ‘যে কর্তৃপক্ষের কাছে তারা নিবন্ধিত তাদের দায়িত্ব হবে এসব সংগঠনকে যথাযথ পর্যবেক্ষণ করা। নির্বাচন না হবে তৎক্ষণিক নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। তিনি আরো বলেন, ‘বেসরকারি সংগঠন হলেও তাদের আইনগত অস্তিত্ব আছে। যথাযথভাবে নির্বাচন হয়েছে কি না তা তদারকি করতে হবে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে। ভোট না হলে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। এতেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে বলে আমি মনে করি।’
নিবন্ধন শর্তানুযায়ী যদি ভোট করার কথা থাকে এবং তা না করা হলে – অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
ভোট ও নির্বাচনবিহীন নেতা মনোনীত হচ্ছে দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকেও। প্রাচীন বাণিজ্য সংগঠন ডিসিসিআই ও এমসিসিআইতেও অনির্বাচিত প্রতিনিধি। গার্মেন্টস মালিকদের প্রভাবশালী দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতা নির্বাচিত করা হচ্ছে বিনা ভোটে। বস্ত্রশিল্প মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ-তেও একই হাল-হকিকত। আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবি’র অবস্থা ভিন্ন কিছু নয়। আমাদের পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, দেশের গুরুত্বপূর্ণ ৩ শতাধিক বাণিজ্য সংগঠনে এখন আর ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচন করা হয় না।
এ প্রসঙ্গে লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘একটি দেশের শিল্প ও ব্যবসার জন্য চেম্বার খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন চেম্বারগুলো। ওইসব প্রতিষ্ঠানের নেতা নির্বাচনও খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
জনাব আবুল মাকসুদ আক্ষেপের সাথে বলেন, ‘বর্তমানে গোপন ব্যালটের পরিবর্তে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যস্থতায় ব্যবসায়ী সংগঠন ও চেম্বারগুলোর নেতা মনোনীত হচ্ছেন, যাদের কোনোভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধি বলা যায় না’। এ প্রবণতা জাতীয় রাজনীতির চরিত্রেরই প্রতিফলন বলে তিনি মনে করেন। ‘ভোটারবিহীন নির্বাচনের যে সংস্কৃতি আমাদের এখানে গড়ে উঠেছে তারই প্রতিফলন ঘটছে প্রতিটি পেশাজীবী সংগঠনে, এটা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির অগ্রগতির সহায়ক নয়’ বলে জনাব মকসুদ অভিমত দেন।
জানা যায়, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের মিনি পার্লামেন্ট খ্যাত বাণিজ্য সংগঠন এফবিসিসিআইর সর্বশেষ ২০১৯-২০২১ মেয়াদের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচনে সব পরিচালক প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করা হয়। পদ ও প্রার্থীর সংখ্যা সমান হওয়ায় বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা অনুযায়ী পরিচালক পদে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এফবিসিসিআইর সাধারণ পর্ষদের সদস্যদের ভোটহীন এ নির্বাচনকে বিরল দৃষ্টান্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও বিগত বিএনপি সরকার আমলে এফবিসিসিআইর নির্বাচনে সভাপতি, প্রথম সহসভাপতি ও সহসভাপতি পদে ভোটাধিকার হারান সংগঠনটির সাধারণ পরিষদের সদস্যরা। এরপর দেশে বারবার ভোটাধিকার খর্ব করা হচ্ছে এফবিসিসিআইতে। তখন যুক্ত করা হয় মনোনীত পরিচালক প্রথা। কোন কোন বাণিজ্য সংগঠন থেকে মনোনীত পরিচালক হবেন, তা ঠিক করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এফবিসিসিআইর সাধারণ পর্ষদের সদস্যদের ভোটহীন এ নির্বাচনকে বিরল দৃষ্টান্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন ব্যবসায়ীরা।
এর পর থেকে এফবিসিসিআইর প্রতিটি নির্বাচনে সাধারণ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত পরিচালক ও মনোনীত পরিচালকদের ভোটে নির্বাচিত হন সভাপতি ও দুই সহসভাপতি। জানা গেছে, এবার ভোট হচ্ছে না প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি- বিজিএমইএতে। সংগঠনটির সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি ও জায়ান্ট গ্রুপের কর্ণধার ফারুক হাসান পরবর্তী সভাপতি হচ্ছেন বলে তৈরি পোষাকখাতের মালিকদের মধ্যে চাপা গুঞ্জন রয়েছে। আগামী মার্চের শেষ সপ্তাহে এ নির্বাচন ঘিরে ফারুক হাসানের পক্ষে সরকার সমর্থক ব্যবসায়ীরা খুবই তৎপর। বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হকের নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী এপ্রিলে। তিনি সভাপতি হয়েছিলেন মালিকদের দুই পক্ষ সম্মিলিত পরিষদ ও ফোরামের সমঝোতায়। এর আগে সংগঠনটির সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানও সমঝোতা করেই সভাপতি হন। এতে ভোটবঞ্চিত হন গার্মেন্টস মালিকরা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘দেশের এখন সব ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করা হয়েছে। ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। প্রায় শতভাগ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানই এখন সরকার সমর্থকদের দখলে। তাই এসব প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না।’ দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের শূন্যতা থাকলে এমনটাই হয় বলে জনাব মিন্টুর অভিমত। কার্যত বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে এখন অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে মনে করে এই ব্যবসায়িক নেতা।
এফবিসিসিআইর আরেক সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, ‘সারা দেশের বাণিজ্য সংগঠনগুলোয় সরাসরি ভোট না হওয়ায় সাধারণ ব্যবসায়ীদের সম্মান থাকে না। নেতৃত্বের জবাবদিহিতাও থাকে না। সাধারণ ব্যবসায়ীরা সঠিক সেবা থেকে বঞ্চিত হন। নেতৃত্বের যোগ্যতা নির্বাচনে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোয় সরাসরি ভোট হওয়া জরুরি।’
মিই/নসদ/১৬৩৩
আপনার মতামত জানানঃ