অনলাইনে সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর দমন-পীড়ন বন্ধ করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সোমবার (২৬ জুলাই) ভোরে এক ব্রিফিংয়ে এই আহ্বান জানায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। একইসঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল বা আইনটি আন্তর্জাতিক মান ও মানবাধিকার আইনের অনুসরণে সংশোধনের আহ্বানও জানিয়েছে সংস্থাটি। সূত্র মতে, ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রবর্তন করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সামাজিক মাধ্যম, ওয়েবসাইট এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্লাটফর্মে ‘ভিন্নমত দমনের জন্য’ ক্রমাগতভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে; এই আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে রয়েছে যাবজ্জীবন।
অ্যামনেস্টির অভিযোগ
সংস্থাটির অভিযোগ, ভিন্নমত দমনের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে বাংলাদেশের ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা। একইসঙ্গে নিজেদের ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এই সংস্থাটি।
‘নো স্পেইস ফর ডিসেন্ট’ শীর্ষক এই ব্রিফিংয়ে সামাজিক মাধ্যমে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সমালোচনা করায় গুম, বিনা বিচারে আটক ও নির্যাতনের মতো নানান ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ১০ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) অধীনে দায়েরকৃত মামলা পর্যালোচনা করা হয়েছে।
ব্রিফিংয়ে বলা হয়, ২০২১ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে ডিএসএ’র অধীনে দায়ের হওয়া মামলায় কমপক্ষে ৪৩৩ জন কারাবন্দি আছেন; যাদের বেশিরভাগকেই অনলাইনে ভুল এবং আক্রমণাত্মক তথ্য প্রকাশের অভিযোগে আটক করা হয়েছে।
যাদেরকে আইনটির লক্ষ্য বানানো হয়েছে তাদের মধ্যে সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট, গায়ক, অ্যাক্টিভিস্ট, উদ্যোক্তা, শিক্ষার্থী এমনকি লেখাপড়া না জানা এক কৃষকও রয়েছেন। ডিএসএ’র অধীনে একটি মামলায় লেখক মুশতাক আহমেদ বিচারবিহীনভাবে ১০ মাস ধরে কারাগারে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করেছেন। একজন কারাবন্দী অভিযোগ করেছেন তাকে নির্যাতন করা হয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’র দক্ষিণ এশিয়া ক্যাম্পেইনার সাদ হাম্মাদি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় নেওয়া পদক্ষেপ থেকে স্পষ্ট, বর্তমানে বাংলাদেশে কোনো কিছুর প্রতিবাদ করা বা ভিন্নমত পোষণ ‘কতটা বিপদজ্জনক’ হয়ে উঠেছে।
বিভিন্ন ধরনের মতপ্রকাশে এমন অন্যায্য বিধিনিষেধ আরোপ বাংলাদেশি সমাজের সর্বস্তরে ভয়ের বার্তা ছড়িয়েছে এবং স্বাধীন মিডিয়া ও সুশীল সমাজের কাজের পরিসরকে সংকুচিত করেছে। দাবি জানানো হয়, শুধুমাত্র নিজেদের মতপ্রকাশের অধিকার চর্চার কারণে যেসব মানুষকে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ বন্দী করেছে তাদেরকে অবশ্যই মুক্তি দিতে হবে।
শুধু অনলাইনে একটি মন্তব্য করার কারণে যে কোনো জায়গায় অভিযান চালানো, ডিভাইস ও তাতে থাকা তথ্যাদি জব্দ করা এবং বিনা ওয়ারেন্টে ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার মতো নির্বিচার ক্ষমতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রদান করে ডিএসএ।
এ ধরনের অনুশীলন ইন্টারন্যাশনাল কভেনেন্ট অন সিভিল এন্ড পলিটিক্যাল রাইটস (আইসিসিপিআর) দ্বারা সুরক্ষিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার লঙ্ঘন; যেখানে বাংলাদেশও একটি স্বাক্ষরকারী পক্ষ।
সাদ হাম্মাদি বলেন, ডিএসএসহ যাবতীয় আইনকে আইসিসিপিআর এর সাথে সাযুজ্যপূর্ণ করতে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে ২০১৮ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউ চলাকালীন জাতিসংঘের বিভিন্ন সদস্য দেশের যেসব সুপারিশ তারা গ্রহণ করেছিলেন সেগুলোর বিষয়ে আমরা বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।
জাতিসংঘের সুপারিশ গায়ে মাখেনি সরকার
আইনটি প্রণয়নের আগে জাতিসংঘের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংক্রান্ত এবং মানবাধিকার রক্ষকদের পরিস্থিতি সংক্রান্ত বিশেষ দূতরা ডিএসএ’র খসড়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
অনলাইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার স্বার্থে ডিএসএ সংশোধনের জন্য বাংলাদেশের ইউপিআর-এ জাতিসংঘের বেশ কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে সুপারিশ করেছে। এসব সুপারিশ গ্রহণ করার পরও সরকার এখন পর্যন্ত নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে।
ব্রিফিং এ বলা হয়, মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনা করে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেয়ার কারণে ২০২১ সালের ২৬ই ফেব্রুয়ারি মানবাধিকারকর্মী রুহুল আমিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে অযাচিত জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং জামিনে মুক্তির আগে তাকে ৪৫ দিন কারাবন্দী রাখা হয়।
কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট করার কারণে ২০২০ সালের মে মাসে লেখক মুশতাক আহমেদকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরপর ৬ বার জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর ২০২১ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি তিনি কারাগারে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বলে জানা যায়।
ব্রিফিং-এ সাদ হাম্মাদি বলেন, কারাগারে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করা তো দূরের কথা, মুশতাক আহমেদের এক মিনিটও কারাগারে থাকার কথা ছিলো না।
ডিএসএ’র অনেকগুলো ধারায় এমন অনেক কাজকে অপরাধ বানানো হয়েছে যেগুলো আদৌ কোনো অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত নয়। ভিন্নমত দমনের জন্য আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের এই অনুশীলন থেকে বেরিয়ে আসতে আমরা কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি।
ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার
ব্রিফিং এ বলা হয়, সমালোচনাকারীদের হয়রানি করতে আইনটির কয়েকটি ধারাকে কর্তৃপক্ষ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে এমন উদ্বেগজনক নমুনা খুঁজে পেয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
এসব ধারার মধ্যে রয়েছে ২৫ (বানোয়াট, আক্রমাণাত্মক এবং হুমকি সৃষ্টিকারী তথ্যের প্রচার, প্রকাশ প্রভৃতি), ২৯ (মানহানিকর তথ্যের প্রচার, প্রকাশ প্রভৃতি) এবং ৩১ (আইনশৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটানোর শাস্তি, প্রভৃতি) ধারা।
ডিএসএ’র আওতায় দায়েরকৃত মামলাসহ অন্যান্য সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত মামলার বিচারের দায়িত্বে থাকা ঢাকার সাইবার ট্রাইবুনাল ২০২১ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ৬ই মে পর্যন্ত মোট ১৯৯ টি মামলা নথিভুক্ত করেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দেখেছে এসব মামলার মধ্যে ১৩৪টিতে ডিএসএ’র কোনো এক বা একাধিক ধারা স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ (১৩৪ এর মধ্যে ১০৭ টি) মামলা নথিভুক্ত হয়েছে ডিএসএ’র ২৫ এবং ২৯ উভয় ধারায়।
এতে দেখা যায়, ১০ জনের মধ্যে ৬ জনের বিরুদ্ধে ডিএসএ’র ৩টি ধারায়ই মামলা হয়েছে। অন্য ৩ জনের বিরুদ্ধে হয়েছে ২৫ এবং ৩১ উভয় ধারায়।
ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-এ যেভাবে মানহানিকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তাতে মারাত্মক ত্রুটি পরিলক্ষিত হয় এবং এর মাধ্যমে আইনটি ভিন্নমত দমনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। মানহানিকে ফৌজদারি আইনের বদলে দেওয়ানি আইনে বিচারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছে।
অকারণে মামলা করে হেনস্থা
১ জানুয়ারি থেকে ৬ মে ২০২১; এই সময়ে ঢাকার সাইবার ট্রাইবুনাল পর্যাপ্ত আইনি ভিত্তি ও প্রমাণাদি না থাকায় প্রায় ৫০ শতাংশ (১৯৯ এর মধ্যে ৯৭ টি) মামলা খারিজ করে দেয়।
ব্রিফিং-এ সাদ হাম্মাদি বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অধীনে দায়েরকৃত মামলা খারিজের পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায় বাংলাদেশের ক্ষমতাধর লোকেরা কিভাবে ভিন্নমত দমনের জন্য এই আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন।
এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইউপিআর-এ জাতিসংঘের যেসকল সদস্য রাষ্ট্র বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, ডিএসএ’র আওতায় লঙ্ঘিত মানবাধিকারের জন্যও তাদের উদ্বেগ জারি থাকতে হবে। একইসাথে ভিন্নমত যাতে আর দমনের শিকার না হয় তা নিশ্চিত করতে তাদের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭০৬
আপনার মতামত জানানঃ