পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা অহরহ ঘটলেও তা এখনও নজরের বাইরেই থেকে যাচ্ছে সবার। শিশুমৃত্যু রোধে অনেক পদক্ষেপ নেয়া হলেও পুকুরে পড়ে মৃত্যু রোধ নিয়ে কোনো পদক্ষেপের নজির নেই। বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। এটার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বহুদিন ধরেই। কিন্তু পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে সরকারি প্রচেষ্টা যেমন কম, স্বাস্থ্য খাতের নীতি দলিলে এই মৃত্যু রোধের বিষয়ে গুরুত্বও কম। পানিতে ডুবে মৃত্যুতে বাংলাদেশ বিশ্বে ২২তম। প্রথম আফ্রিকার গায়ানা। বাংলাদেশ ছাড়া প্রথম ২২টির ১৯টিই আফ্রিকার দেশ।
সুনামগঞ্জে চলতি জুলাই মাসের প্রথম ২২ দিনে পানিতে ডুবে ৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে কিন্তু নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর তথ্য নেই। সেই ৬ জনের সবার বয়স আট বছরের নিচে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর পানিতে ডুবে সাড়ে ১৪ হাজার শিশু মারা যায়। এদের বয়স ১ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। এই বয়সী শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ এখন পানিতে ডুবে মারা যাওয়া।
আজ রোববার(২৪ জুলাই) পালিত হচ্ছে পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক দিবস। এবারই প্রথম এই দিবস পালিত হচ্ছে। চলতি বছরের গত ২৮ এপ্রিল জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২৫ জুলাই এ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়।
শিশু বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান (বিএমডিসি) অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডায়রিয়ায় মৃত্যু রোধে এবং এর ব্যবস্থাপনায় আমরা বিশ্বে এক নম্বর। গণটিকা দেওয়ার কারণে ডিফথেরিয়া বলতে গেলে নেই। ধনুষ্টঙ্কার একদম নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রতিরোধ করতে পারছি না আমরা। এ নিয়ে দেড় যুগ ধরে আলোচনা চলছে। কিন্তু নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সুদৃষ্টির অভাব আছে।’
পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর পরিসংখ্যান
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২০’-তে দেশে বিভিন্ন রোগে মৃত্যুর চিত্র তুলে ধরা হয়। তাতে দেখা যায়, ৫ বছরের কম বয়সী ৪৪ শতাংশ শিশুর মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া। এরপরই পানিতে ডুবে মৃত্যুর স্থান। এটি প্রায় ৯ শতাংশ। এরপর আছে শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা, অপুষ্টি, নানা ধরনের জ্বর, জন্ডিস ও জটিল ডায়রিয়া।
২০১৬ সালে করা বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে অনুযায়ী, দেশে ১ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর (আঘাতজনিত) ৩৭ শতাংশই হয় পানিতে ডুবে। সে হিসাবে বছরে সাড়ে ১৪ হাজার শিশু ডুবে মারা যায়।
বিবিএসের ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসে ডুবে মারা যাওয়ার পরিসংখ্যানে শিশুর বয়স নির্দিষ্ট করা হয়নি। ফলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণায়ের অধীন বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভের তথ্যের সঙ্গে বিবিএসের তথ্যের ফারাক আছে। পানিতে ডুবে মৃত্যুর তথ্য বলছে, ১ মাস থেকে ১২ মাস বয়সীদের ক্ষেত্রে এটা সচরাচর ঘটে না। ১২ মাস থেকে ৫ বছর বয়সীদের মধ্যে এটা বেশি হয়। হেলথ অ্যান্ড ইনজুরি সার্ভে অনুযায়ী, এই বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রতি ১ লাখে ৭১ দশমিক ৭ জন ডুবে মারা যায়। ৬ থেকে ৯ বছরের শিশুর ক্ষেত্রে এটা লাখে ২৮ দশমিক ১ জন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পানিতে ডুবে মৃত্যুসংক্রান্ত বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া দুষ্কর। এরপরও ডুবে মৃত্যুর ৯১ শতাংশ ঘটে বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয়।
পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে করণীয়
শিশুমৃত্যু রোধ, পুষ্টি ইত্যাদি খাতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বড় বিনিয়োগ থাকলেও পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে তৎপরতা একেবারেই কম। যা-ও হয়, তা কিছু পাইলট কর্মসূচি। যেমন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আছে দুটি কর্মসূচি। দুটোই শিশুদের সাঁতার শেখানোর। এর মধ্যে একটি কর্মসূচি গত জুন মাসে শেষ হয়েছে। এ কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল তিন লাখ শিশুকে সাঁতার শেখানোর। শেখানো হয়েছে ২ লাখ ৯৮ হাজার শিশুকে। এ তথ্য দিয়েছেন কর্মসূচি দুটোর পরিচালক পাপিয়া ঘোষ। আরেকটি কর্মসূচিতে দুই লাখ শিশুকে সাঁতার শেখানো হবে। দুই প্রকল্পের জন্য বাজেট ৫ কোটি করে ১০ কোটি টাকা। দুটো কর্মসূচিরই বাস্তবায়ন এলাকা ফরিদপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ ও নড়াইল জেলা। কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে স্থানীয় এনজিওগুলো।
কিন্তু দেশে সবচেয়ে বেশি পানিতে ডুবে মৃত্যু হয় বরিশাল বিভাগে। জাতীয় পর্যায়ে যেখানে লাখে ১১টি শিশুর মৃত্যু হয়, সেখানে বরিশাল বিভাগে এ সংখ্যা ৩৪। দুই কর্মসূচির একটিও বরিশাল বিভাগে নেওয়া হলো না কেন, জানতে চাইলে পাপিয়া ঘোষ বলেন, ‘যেসব এনজিও প্রস্তাব নিয়ে আসে, তাদেরই কাজ দেওয়া হয়। এখানে এনজিওগুলোই কাজ পাওয়ার ব্যাপারে সক্রিয়।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্যসেবা অর্থায়ন কৌশল ২০১২-৩১-এ পানিতে ডুবে মৃত্যুর বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। আবার ‘অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বহু খাতভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ২০১৮-২৫’-এ ১০ দফা লক্ষ্যমাত্রা তুলে ধরা হয়েছে। তাতেও পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে কোনো লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়নি।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা এত বেশি হলেও তা রোধ করতে সরকারি তৎপরতা একেবারে নগণ্য।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৩১২
আপনার মতামত জানানঃ