ইসরায়েলের তৈরি হ্যাকিং সফটওয়্যার পেগাসাস ব্যবহার করে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো নজরদারি চালাচ্ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনীতিকদের ফোনে নজরদারি চালানোর এই ঘটনা ফাঁস হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টসহ বিভিন্ন দেশের ১৭টি গণমাধ্যম একযোগে এসব তথ্য বের করতে কাজ করেছেন। আর এই ডিজিটাল ফরেনসিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পরীক্ষাগারে। এ তদন্তের জন্য ৬৭টি মুঠোফোনের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ইসরায়েলের গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা প্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘এনএসও গ্রুপ’ স্পাইওয়্যার ‘পেগাসাস’-এর উদ্ভাবক। ধারণা করা হয়, ২০১৬ সাল থেকে পেগাসাস কখনও ‘কিউ সুইট’, কখনও বা ‘ট্রাইডেন্ট’ নামে ব্যবহার করা হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে অত্যাধুনিক স্পাইওয়্যার সফটওয়্যারগুলোর মধ্যে পেগাসাসকে সবচেয়ে কার্যকর বলে মনে করা হয়। এটি সহজেই আইওএস, অ্যাপল ও অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনে অনুপ্রবেশ করতে পারে বলে এনডিটিভি সংবাদমাধ্যটি জানায়।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাইবার সিকিউরিটি ল্যাব পরিচালনাকারী ক্লডিও গার্নিয়েরি গার্ডিয়ানকে বলেন, “যদি কোনো ফোনে (স্মার্টফোন) পেগাসাস সফটঅয়্যারটি ঢোকানো যায়, তবে এনএসওর গ্রাহক পুরো ফোনটির দখলই পেয়ে যাবে।ফোনের মালিকের মেসেজ, কল, ছবি, ইমেইল সবই দেখতে পাবে, এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, সিগন্যালের বার্তাগুলোও পড়তে পারবে। গোপনে ক্যামেরা কিংবা মাইক্রোফোন চালুও করতে পারবে।”
এই হ্যাকিংয়ের লক্ষ্যবস্তুর তালিকায় ভারতের অন্তত ৩০০ রাজনীতিক, সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, বিজ্ঞানীর নাম থাকার কথা জানিয়েছে দেশটির নিউজ ওয়েসাইট দ্য অয়্যার। তবে ভারত সরকার এই আড়িপাতায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ফাঁস হওয়া একটি ডেটাবেইসে এই ফোন নম্বরগুলো প্রথমে পায় প্যারিসভিত্তিক সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিজ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, পরে তারা গার্ডিয়ান, দ্য অয়্যারসহ ১৭টি সংবাদ মাধ্যমকে তা জানায়। তারা সবাই মিলে এই অনুসন্ধানের নাম দিয়েছে ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’। এনএসওর দাবি, অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের উপর নজরদারি চালানোই তাদের এই স্পাইঅয়্যার তৈরির লক্ষ্য। তবে তা গোপনে ব্যবহার করতে বিভিন্ন দেশের সরকার এনএসওর গ্রাহক হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এই হ্যাকিংয়ের লক্ষ্যবস্তুর তালিকায় ভারতের অন্তত ৩০০ রাজনীতিক, সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, বিজ্ঞানীর নাম থাকার কথা জানিয়েছে দেশটির নিউজ ওয়েসাইট দ্য অয়্যার। তবে ভারত সরকার এই আড়িপাতায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার বৈধ লাইসেন্সের মাধ্যমে পেগাসাস ব্যবহার করছে। ২০১৯ সাল থেকে সীমিত পরিসরে এই হ্যাকিং প্রযুক্তি বিক্রি শুরু করে। প্রাথমিক অবস্থায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোই ছিল এর প্রধান ক্রেতা। সফটওয়্যারটির উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসবাদ নিয়ে অনুসন্ধান ও বৈশ্বিক অপরাধ প্রতিরোধের মাধ্যমে হাজারো মানুষকে রক্ষায় সরকারি সংস্থাকে সহায়তার করে তারা।
পেগাসাসের বিরুদ্ধে তথ্য ফাঁসের ঘটনা এটাই প্রথম নয়, ২০১৯ সালের শেষ দিকে ফেসবুকের মালিকানাধীন মেসেজিং সার্ভিস হোয়াটসঅ্যাপ জানায়, ওই বছরের মে মাসে বিশ্বের ২০টি দেশের প্রায় ১ হাজার ৪০০ হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীকে পেগাসাস টার্গেট করে। এর মধ্যে বেশ কিছু ভারতীয় সাংবাদিকও রয়েছেন বলে জানায় তারা।
এদিকে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার আগে ও পরে তার ঘনিষ্ঠজনদের মুঠোফোনে আড়ি পাতা হয়েছিল পেগাসাস দ্বারা। গোপনে এ কাজ করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপের তৈরি পেগাসাস নামের সফটওয়্যার। ডিজিটাল ফরেনসিক বিশ্লেষণে এসব তথ্য জানা গেছে। ফরেনসিক বিশ্লেষণ বলছে, আড়ি পাতা হয় খাসোগির স্ত্রী হানান এলাতার ও তার বাগদত্তা হেতিজে চেঙ্গিসের ফোনে। খাসোগি হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শীর্ষ দুই তুর্কি কর্মকর্তার ফোনেও এভাবে আড়ি পাতা হয়।
সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যা করা হয় তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি আরবের কনস্যুলেটের ভেতরে। ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর তাকে কনস্যুলেটের ভেতরে হত্যা করা হয়। কিন্তু তার মরদেহ কোথায় ফেলে দেওয়া হয়েছে, তার হদিস এখনও মেলেনি। এ হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই সন্দেহের তির ছিল সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের দিকে। কারণ, যুবরাজ সালমানসহ সৌদি আরবের শাসকগোষ্ঠীর কঠোর সমালোচক ছিলেন খাসোগি। এ নিয়ে তিনি বেশ কিছু লেখা লিখেছেন ওয়াশিংটন পোস্টে। যদিও সৌদি আরব এই হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিল। বিভিন্ন তদন্তে উঠে এসেছে, এ হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দিয়েছিলেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
ফরেনসিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, হাঙ্গেরির যে তিনজনের ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে, তাদের দুজন সাংবাদিক, একজন ব্যবসায়ী। আর যে দুজনের ফোনে স্পাইওয়্যার ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছে, তাদের একজন অ্যাকটিভিস্ট, অপরজন উদ্যোক্ত। খবরে বলা হয়, সাংবাদিকসহ অন্য যারা সরকারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে বা সরকারের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে, তাদের নজরদারি করতে অরবানের সরকার স্পাইওয়্যার ব্যবহার করেছে।
৫০ হাজারের বেশি ফোন নম্বরের একটি তালিকা ফাঁস হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৬ সাল থেকে এনএসওর গ্রাহকেরা এসব নম্বরে আড়ি পেতেছে। এ তালিকায় হাঙ্গেরির তিন শতাধিক ফোন নম্বর পাওয়া গেছে। এই ফোন নম্বরগুলো সাংবাদিক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, অ্যাকটিভিস্টসহ অন্যদের।
হাঙ্গেরির যেসব ফোন নম্বর পাওয়া গেছে, তার মধ্যে কতগুলোতে পেগাসাসের মাধ্যমে আড়ি পাতা হয়েছে বা আড়ি পাতার চেষ্টা হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে তালিকায় থাকা নম্বর ব্যবহার করা হতো, এমন ছয়টি মুঠোফোনের ফরেনসিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ বিশ্লেষণে দেখা যায়, তিনটি ফোনে পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে নজরদারি চালানো হয়েছে। দুটি ফোনে স্পাইওয়্যার ঢোকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। অপর ফোনটির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যায়নি।
প্রতিষ্ঠানটির মানবাধিকারবিষয়ক নীতিতে বলা হয়েছে চুক্তি অনুযায়ী কিছু বাধ্যবাধকতা মেনে চলে তারা। এর মধ্যে রয়েছে আলোচিত সন্ত্রাসবাদ ও অপরাধ তদন্ত এবং প্রতিরোধ করা। নিজেদের পণ্যের মাধ্যমে যেন মানবাধিকার লঙ্ঘিত না হয়, সে বিষয় নিশ্চিত করতে তারা সতর্ক বলেও উল্লেখ করা হয়। এরপরও গোপনে সরকারিভাবে পেগাসাস দ্বারা বিশেষ ব্যক্তিদের ফোন হ্যাকিংয়ের এই তথ্য বিশেষজ্ঞদের শঙ্কায় ফেলে দিয়েছে। সফটওয়্যারটি ভালো উদ্দেশ্যে ব্যবহারের পাশাপাশি সরকারের ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার হচ্ছে এমন আশঙ্কাই তাদের চিন্তিত করে তুলছে এই সফটওয়্যারটির ব্যাপারে।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৫৩৫
আপনার মতামত জানানঃ