গোটা বিশ্বেই করোনার নতুন ধরন ডেল্টার কারণে তৃতীয় ঢেউ চলছে। করোনা মহামারিতে সবচেয়ে বেশি বিধ্বস্ত ইউরোপের দেশগুলো মহামারি ছাড়িয়ে নতুন এক আতঙ্কে ভুগছে। জার্মানিসহ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো ভয়াবহ বন্যায় বিধ্বস্ত। এপর্যন্ত সহস্রাধিক মানুষ নিখোঁজসহ ৭০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
শুক্রবার বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়, মৃতদের বেশিরভাগই জার্মানির নাগরিক, আর বেলজিয়ামে কমপক্ষে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ডয়চে ভেলে জানিয়েছে, বন্যা দুর্গত আরভেইলার অঞ্চলে অনেকে নিখোঁজ। বহু বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হেলিকপ্টার দিয়ে দুর্গত এলাকা থেকে মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
জার্মানির রাইনল্যান্ড-পালাটিনাটে এবং নর্থ রাইন-ভেস্টফালিয়া প্রদেশ বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই দুই প্রদেশে এখনো অনেকে নিখোঁজ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই দুই প্রদেশে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, শুধু রাইনল্যান্ড-পালাটিনেট প্রদেশের আহরওয়েইলার এলাকায় এখনো ১ হাজার ৩০০ জন নিখোঁজ।
স্থানীয় প্রশাসনের বরাতে ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদনে জানানো হয়, জার্মানির বাড নয়নার-আরভেইলার জেলায় প্রয় ১ হাজার ৩০০ জনের খোঁজ মিলছে না। সেখানে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক অকেজো হয়ে পড়েছে। প্রশাসন ধারণা করছে, যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপর্যয়ের কারণে এসব বাসিন্দার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রায় সাড়ে তিন হাজার নাগরিকের জন্য জরুরি আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখানে।
জার্মানিতে এই আকস্মিক বন্যা নিয়ে অনেক অঞ্চলে আগে থেকে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে। জার্মানির পত্রিকা বিল্ড একে ‘মৃত্যুর বন্যা’ আখ্যা দিয়েছে।
মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, বুধবার রাতে শুরু হওয়া এই বন্যায় জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলীয় রাইনলান্ড-পালাটিনেট প্রদেশে ৬টি ভবন ধসে পড়েছে এবং নিখোঁজ আছেন অনেকে। জীবন বাঁচাতে বিভিন্ন বাসা-বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিয়েছেন লোকজন।
স্থানীয় পুলিশের এক মুখপাত্র জানান, বন্যা থেকে বাঁচতে অনেক মানুষ অবস্থান নিয়েছে বাড়ির ছাদে। তবে সেখানে মোট কতজন অবস্থান করছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। অনেক এলাকায় ফায়ার সার্ভিস ও উদ্ধারকারী দলের সদস্যদের পাঠানো হয়েছে। উদ্ধারকাজ এখনো অব্যাহত আছে। শেষ হলে প্রকৃত অবস্থা জানা যাবে।
এদিকে বন্যার কারণে দেশটির রাইন নদীতে নৌ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্ধ রয়েছে স্থানীয় রেল, সড়ক ও নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা। ভারী বৃষ্টির কারণে অনেক এলাকায় প্রবেশ করতে পারছে না উদ্ধারকারী বাহিনী। জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে প্রদেশের ভুলকানাইফেল জেলায়।
বন্যায় জার্মানিতে কমপক্ষে দুই লাখ বাড়িঘরের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
রাইন নদীতে বন্যায় শুক্রবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় কলন ও হাগেনসহ নদী তীরবর্তী বিভিন্ন শহর প্লাবিত হয়েছে। লেফারকুসেন শহরের একটি হাসপাতাল থেকে ৪০০ রোগীকে স্থানান্তর করা হয়েছে। ভুপেরটাল শহরে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, তাদের বাড়িঘরের সেলার তলিয়ে গেছে এবং বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন তারা।
জার্মানিতে এই বন্যায় প্রাণহানির সংখ্যা সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর আগে ২০০২ সালের বন্যায় ২১ জনের মৃত্যু হয়।
দেশের এই নাজুক পরিস্থিতি নিয়ে চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল বলেছেন, ‘আমি এটা ভয় পাচ্ছি যে আসছে দিনগুলোয় বিপর্যয় বড় আকার ধারণ করবে।’ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পূর্ণ সহযোগিতা দেওয়া হবে বলে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন থেকে তিনি এ বার্তা দিয়েছেন।
বন্যায় প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতিতে শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মেরকেল।
যুক্তরাষ্ট্র সফররত মেরকেল বলেন, “আমি বিস্মিত যে এই দুর্যোগ কবলিত এলাকায় এত বেশি সংখ্যক নাগরিককে দুর্দশা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। মৃত ও নিখোঁজদের পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা জানাচ্ছি।” ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তার ঘোষণাও তিনি দিয়েছেন।
জার্মানি ছাড়াও ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশে বন্যা দেখা দিয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ বেলজিয়ামে বন্যায় প্রাণ হারিয়েছে ১১ জন। এ ছাড়া নেদারল্যান্ডস ও লুক্সেমবার্গ এই বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নেদারল্যান্ডসের মাসত্রিস শহর থেকে হাজারো মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ইউরোপের ওই অঞ্চলে শুক্রবারও ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনের সময় নর্থ রাইন-ভেস্টফালিয়া প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আরমিন ল্যাশেট এই চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার জন্য বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে দায়ী করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চরম আবহাওয়া ফিরে ফিরে আসার ঘটনা বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে একটি একক ঘটনাকে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলাটা একটু জটিল।
ফেসড্রে নদী উপচে বন্যায় বেলজিয়ামের পূর্বাঞ্চলীয় শহর পেপিনস্টারে ১০টি ঘর ধসে পড়েছে। শহরের এক হাজার বাড়িঘর থেকে বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ভারি বর্ষণে বেলজিয়ামে গণপরিবহন ব্যবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছে, জার্মানি অভিমুখী উচ্চ-গতির থালিস ট্রেন সার্ভিস বাতিল করা হয়েছে। প্লাবনের আশঙ্কায় ময়সে নদীতে, সেদেশের গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ, নৌ-চলাচল স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।
নেদারল্যান্ডসের বিভিন্ন নদীতে পানি বেড়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করায় দক্ষিণের লিমবার্গ প্রদেশে অনেক বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানকার বেশকিছু বয়স্ক সেবাকেন্দ্র খালি করে ফেলা হয়েছে।
তবে সেদেশে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত কোন প্রাণহানীর খবর পাওয়া যায়নি। নেদারল্যান্ডসের মাসট্রিখট শহরের ১০ হাজার বাসিন্দাকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন ওই অঞ্চলে গত ২৪ ঘণ্টায় অপ্রত্যাশিত পরিমাণে ভারী বর্ষণ হয়েছে। নিম্নচাপজনিত আবহাওয়া ফ্রান্সের পশ্চিমে, বেলজিয়ামে ও নেদারল্যান্ডে দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টিপাতের প্রভাবক হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪১
আপনার মতামত জানানঃ