বন্ধু রাষ্ট্র! এই গালগল্পের ভীড়ে সীমান্ত হত্যা যেন স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে সীমান্তবর্তী মানুষদের জন্যে। বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকবার সীমান্ত হত্যা বন্ধ আলোচনা এবং চুক্তি হয়েছে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনাতেও কোনও সমাধান আসেনি, যার ফলে সীমান্ত হত্যা চলছেই।
গতকাল রোববার (১১ জুলাই) দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ সীমান্তের বিপরীতে ভারতে বিএসএফ’র গুলিতে আব্দুর রাজ্জাক (১৯) নামে এক বাংলাদেশি যুবক নিহত হয়েছেন। আব্দুর রাজ্জাক কালিগঞ্জ উপজেলার ভাড়াশিমলা ইউনিয়নের কামদেবপুর গ্রামের রমজান গাজীর ছেলে।
ভাড়াশিমলা ইউপি সদস্য আব্দুল খালেক খান জানান, রাত দুইটা থেকে আড়াইটার মধ্যে তারা সীমান্তে তিনটি গুলির শব্দ, এর কিছুক্ষণ পর আরও একটি গুলির শব্দ শুনেছেন এবং স্থানীয়ভাবে তিনি জেনেছেন সীমান্তের ইছামতি নদী সংলগ্ন হিঙ্গলগঞ্জ বিএসএফ ক্যাম্পের উত্তর পাশ থেকে গুলিতে নিহত আব্দুর রাজ্জাকের মরদেহ বিএসএফ নিয়ে গেছে।
আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে তার চাচা হাবিবুর রহমান সবুজ বলেন, রাজ্জাকের মরদেহ ফেরত আনার জন্য তারা বিজিবির কাছে আবেদন জানিয়েছেন।
সীমান্ত সূত্রমতে, আব্দুর রাজ্জাক দীর্ঘদিন নদীপথে ভারত থেকে গরুসহ অবৈধ মালামাল আনা নেওয়ায় নিয়োজিত ছিল। বিজিবির বসন্তপুর বিওপির হাবিলদার খলিল জানান, আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুর বিষয়টি উল্লেখ করে তার পরিবার বিজিবিকে জানিয়েছে। তাদের পত্র আমলে নিয়ে বিএসএফ’কে চিঠি দেওয়া হবে।
এদিকে তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদলু এজেন্সির ২০২০-এর ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, মানবাধিকার সংস্থার মতে ২০০০-২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কমপক্ষে ১,১৮৫ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ।
বছরভিত্তিক সরকারি হিসেব অনুযায়ী, ২০০৯ সালে সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে মারা যান ৬৬ জন বাংলাদেশি, ২০১০ সালে ৫৫ জন, ২০১১ ও ২০১২ সালে ২৪ জন করে, ২০১৩ সালে ১৮ জন, ২০১৪ সালে ২৪ জন, ২০১৫ সালে ৩৮ জন, ২০১৬ সালে ২৫ জন, ২০১৭ সালে ১৭ জন এবং ২০১৮ সালে ৩ জন মারা যান সীমান্তে।
তবে বেসরকারি সংস্থাগুলোর হিসাবে সীমান্তে হত্যার সংখ্যা অনেক বেশি। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ২৬, ২০১৪ সালে ৩৩, ২০১৫ সালে ৪৬, ২০১৬ সালে ৩১, ২০১৭ সালে ২৪, ২০১৮ সালে ১৪ এবং ২০১৯ সালে ৪৩ টি সীমান্ত হত্যার ঘটনা ঘটেছে। তবে সীমান্ত অঞ্চলে যারা আহত বা অপহরণের শিকার হয়েছিল তাদেরকে এই হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে সীমান্তে মোট ৪৮ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করে বিএসএফ৷ এর মধ্যে ৪২ জনকে গুলি করে এবং ছয় জনকে হত্যা করা হয় নির্যাতন চালিয়ে৷
এদিকে আসকের আরেক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে সীমান্তে ১৫৮ জন বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে যা গড়ে প্রতি ১২ দিনে একজন বাংলাদেশি নাগরিকের মৃত্যু, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে।
আসকের সিনিয়র উপপরিচালক নীনা গোস্বামী বলেন, ‘সীমান্তে কেউ অপরাধ করলেও হত্যা কোনওভাবেই কাম্য নয়। সীমান্ত হত্যা অবশ্যই শূন্যের কোঠায় নেমে আসা উচিত। আমরা দেখতে চাই বর্ডার কিলিং একটাও নাই, এমন একটা পরিবেশ এবং সেই রকম একটা সুসম্পর্ক আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে তৈরি হয়েছে। ‘
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতে বিএসএফ আত্মরক্ষার জন্য হত্যা করে। কিন্তু, বাস্তবতা তা বলে না। বেশ কয়েক বছর আগে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) ‘ট্রিগার হ্যাপি’ নামে একটি প্রতিবেদনে এ ধরনের বেশ কয়েকটি মামলার উল্লেখ করেছে। যেখানে বেঁচে যাওয়া এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন যে বিএসএফ তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা না করে বা সতর্ক না করেই নির্বিচারে গুলি চালায়। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে পিঠে গুলি করা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ-ভিত্তিক ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠন, মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) প্রধান কীরিটি রায় বলেন, ‘আগে বিএসএফ বলত আমাদের ওপর আক্রমন করতে এলে আমরা আত্মরক্ষার্থে গুলি করেছি। লাশ ফেরত দিত। এখন আর তাও বলে না। গুলি করে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেয়। ফেরতও দেয় না।
সীমান্তে গরু ব্যবসীরা যে পরিমাণ হত্যার শিকার হন, মাদক ব্যবসায়ীরা ওই পরিমান হত্যার শিকার হন না। কিন্তু মাদক চোরাচালনই বেশি হয়ে থাকে সীমান্তে। এর পেছনের রাজনৈতিক কারণ নিয়ে আরও আগেই গুরুত্বের সাথে চিন্তাভাবনা শুরু করা উচিৎ ছিলো বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৬৩৭
আপনার মতামত জানানঃ