মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে বিপর্যস্ত জনজীবন। গত দেড় বছর ধরে চলমান করোনা মহামারিতে কর্মসংস্থান হারিয়েছে বহু শ্রমিক, পড়েছে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে।এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বজুড়ে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২০ কোটি ৫০ লাখে। সম্প্রতি জাতিসংঘের শ্রমিক অধিকার বিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে।
২০১৯ সালের শেষ পর্ব থেকে করোনার প্রকোপ শুরু হয়। ২০২০ সালের গোড়ায় তা ব্যাপক চেহারা নেয়। চীন থেকে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। তখন থেকেই কাজের বাজারে মন্দা শুরু হয়েছিল। ইউরোপ, অ্যামেরিকাসহ গোটা পৃথিবীতেই মানুষ কাজ হারাতে শুরু করেন। বিশেষত যারা দিন মজুরের কাজ করেন, তারা সবার আগে কাজ হারান।
আইএলওর বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ছিল ১৮ কোটি ৭০ লাখ (১৮৭ মিলিয়ন)। ২০২২ সাল নাগাদ এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২০ কোটি ৫০ লাখে (২০৫ মিলিয়ন)।
চলতি বছরের শেষ নাগাদ বিশ্বজুড়ে অন্তত ৭ কোটি ৫০ লাখ কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে বলেও শঙ্কা জানানো হয়েছে আইএলওর প্রতিবেদনে। আরও বলা হয়, মহামারি অব্যাহত থাকলে আগামী বছর আরও ২ কোটি ৩০ লাখ কর্মসংস্থান কমে যাবে।
জাতিসংঘের ধারণা, ২০২৩ সালের আগে বাজার চাঙ্গা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ, ওই সময় পর্যন্ত নতুন চাকরির বাজার তৈরি হবে না। হার কমলেও, চাকরি হারাতেই থাকবেন অসংখ্য মানুষ। বাড়বে বেকারত্ব এবং একই সঙ্গে বাড়বে দারিদ্র্য।
আইএলও প্রধান গাই রাইডার সাংবাদিকদের বলেন, ‘করোনা মহামারি শুধু জনস্বাস্থ্যকেই বিপন্ন করছে না, বরং কর্মসংস্থান ও মানবিক জীবনেও বিপর্যয়ে ডেকে এনেছে।’
তবে আইএলও প্রধান বলেছেন, দাপ্তরিক পরিসংখ্যানের বেয়ে বাস্তব অবস্থা অনেক বেশি খারাপ। কারণ, মহামারিতে শুধু যে কর্মসংস্থান হারিয়েছে, তা ই নয়, বরং কর্মঘণ্টাও হ্রাস পেয়েছে মারাত্মকভাবে।
আইএলও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ কর্মঘণ্টা স্রেফ হারিয়ে গেছে। এই পরিমাণ কর্মঘণ্টা ২৫ কোটি ৫০ লাখ (২৫৫ মিলিয়ন) সার্বক্ষনিক চাকরির (ফুলটাইম জব) সমান।
জাতিসংঘের আশঙ্কা, দারিদ্র্যসীমার নীচে নেমে যাবেন বহু মানুষ। তাদেরকে ফের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে বহু সময় লেগে যাবে। কারণ, গত কয়েক বছরে যে নতুন চাকরির বাজার তৈরি হয়েছিল, অতিমারির কারণে তা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। প্রচুর ছোট ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে তা আবার গড়ে ওঠা কঠিন।
ডিডাব্লিউয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের প্রধান। সেখানে তিনি বলেছেন, এক ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছে। কাজের বাজার অনেকটা পিছিয়ে গেছে। সেখান থেকে তাকে টেনে তুলতে অনেক বছর লেগে যাবে। এর ফলে একদিকে দারিদ্র্য বাড়বে, অন্যদিকে বাড়বে হতাশা। যার জেরে গৃহঅশান্তি, মেয়েদের উপর অত্যাচারের পরিমাণও বেড়ে যাবে।
আইএলও প্রধান গাই রাইডার সাংবাদিকদের বলেন, কোভিড-১৯ কেবল জন স্বাস্থ্যের সমস্যা নয় এটি চাকুরি আর মানুষেরও সংকট। তিনি বলেন, উপযুক্ত কাজ সৃষ্টিতে গতি আনতে সুনির্দিষ্ট প্রচেষ্টা এবং সমাজের সবচেয়ে দুর্বল মানুষদের সহায়তা ছাড়া এবং সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ অর্থনৈতিক সেক্টরগুলো পুনরুদ্ধার করা না গেলে মহামারির ভয়াবহ প্রভাব আরও কয়েক বছর থাকবে। মানুষের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা হারানোর পাশাপাশি দারিদ্র আর বৈষম্যও বাড়বে।
বিশ্বজুড়ে মহামারি পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও কর্মসংস্থানের বাজার এর ইতিবাচক প্রভাব থেকে এখনও অনেক দূরে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আইএলও জানিয়েছে, চলতি বছর যে পরিমাণ কর্মঘণ্টা হারাবে, সেটি ১০ কোটি সার্বক্ষনিক চাকরির সমান।
কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার কারণে সৃষ্ট কর্মহীনতার কারণে ২০১৯ সালের তুলনায় গত দেড় বছরে দরিদ্র এবং অতি দরিদ্র মানুষদের সংখ্যায় যুক্ত হয়েছেন ১০ কোটি ৮০ লাখেরও বেশি শ্রমিক। এর অর্থ, কর্মহীন এসব শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা তাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনের জন্য ৩ দশমিক ২০ ডলারের নীচে ব্যায় করছেন। এর বেশি খরচ করার মতো সাধ্য তাদের বর্তমানে নেই।
আইএলওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত বা কর্মহীন শ্রমিকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করতেন। এই খাতগুলোতে সাধারণত এমনিতেই নিশ্চয়তা কম থাক। পাশপাশি, বিশ্বজুড়ে কর্মহীন শ্রমিকদের মধ্যে পুরুষদের তুলনায় নারী শ্রমিকদের শতকরা হার অনেক বেশি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদদের একাংশ অবশ্য আশা করছেন, যেহেতু করোনা টিকা বাজারে এসে গেছে এবং বিশ্বজুড়ে মানুষ ইতোমধ্যে প্রাণঘাতী এই রোগের সঙ্গে ‘মানিয়ে নেওয়া’ অনেকটাই রপ্ত করতে পারছে, সামনের দিনে এই অবস্থা কেটে যাবে। তবে আইএলও এতটা আশাবাদী হতে পারছে না।
সংস্থাটির প্রধান গাই রাইডার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘যদি রাষ্ট্রগুলো নতুন চাকরি বা কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষরা যদি প্রয়োজনীয় সহায়তা না পায় এবং মহামারির কারণে অর্থনীতির যে খাতগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো পুনর্গঠনে মনযোগ না দেয়, তাহলে এই বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও অসাম্য আরও বেশি কয়েক বছর আমাদের তাড়া করবে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩০৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ