প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় গোপন নথি চুরির অভিযোগে অফিসিয়াল সিক্রেটস আইনে করা মামলার জামিন আবেদনের শুনানি শেষ হয়েছে। এদিকে তার জামিন বিষয়ে শুনানি থাকায় সকাল থেকে কারাফটকে অবস্থান নেন সাংবাদিকরা। কিন্তু আজ তার জামিন হয়নি। শুনানি শেষে এ বিষয়ে আদেশ আগামী রোববার দিন ঠিক করে দিয়েছেন আদালত।
আজ বৃহস্পতিবার(২০ মে) দুপুরে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ভার্চুয়ালি এ শুনানি শুরু হয়। ২টার দিকে শুনানি শেষ হয়।
আদালত জানিয়েছেন, এ বিষয়ে রোববার আদেশ দেওয়া হবে।
আদালতে রোজিনা ইসলামের জামিন শুনানিতে অংশ নেন তার আইনজীবীরা। আদালতের সামনে গণমাধ্যমকর্মীরা ভিড় করেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও সেখানে ছিলেন। আদালতের বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন রোজিনা ইসলামের স্বামী মনিরুল ইসলাম ও স্বজনেরা।
দুপুর ২টার দিকে শেষ হয় তার জামিন শুনানি। এর আগে দুপুর ১২টা ৪৯ মিনিটে ঢাকা মহানগর হাকিম বাকী বিল্লার ভার্চুয়াল আদালতে তার জামিন শুনানি শুরু হয়। রোজিনার জামিন শুনানি করেন আইনজীবী এহসানুল হক সমাজি ও প্রশান্ত কুমার কর্মকার।
রোজিনার আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার গণমাধ্যমকে বলেন, সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে ইতিপূর্বে যে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছে তা ছিলো জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট। তিনি একজন পেশাদার সাংবাদিক। তার বিরুদ্ধে যে ধারায় মামলা করা হয়েছে তা সাংঘর্ষিক ও অনাকাঙিক্ষত। রোজিনা ইসলামের একটি শিশু সন্তান রয়েছে, তাছাড়া তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ। সার্বিক বিবেচনায় আমাদের প্রত্যাশা, রোজিনা ইসলাম জামিন পাবেন।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ও দণ্ডবিধিতে করা এই মামলার তদন্তের দায়িত্ব বুধবার ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগকে (ডিবি) দেওয়া হয়েছে। ডিবি আজ জানিয়েছে, রোজিনার মামলার বিষয়ে তারা কোনো চাপে নেই। স্বাধীন তদন্ত হবে।
এর আগে পুলিশ রোজিনা ইসলামকে ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে গত মঙ্গলবার আদালতে হাজির করে। একই সঙ্গে রোজিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড চেয়ে আবেদন করে পুলিশ। অন্যদিকে রোজিনা ইসলামের জামিনের আবেদন জানান তার আইনজীবীরা। ওই দিন শুনানি নিয়ে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসিম রিমান্ড আবেদন নাকচ করেন এবং রোজিনার জামিন আবেদনের ওপর অধিকতর শুনানির জন্য ২০ মে দিন ধার্য করেন। সেদিন আদালতের নির্দেশে রোজিনাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
রোজিনা ইসলাম গত সোমবার দুপুরের পর পেশাগত দায়িত্ব পালনে সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যান। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাকে একটি কক্ষে আটকে রাখেন। প্রায় ছয় ঘণ্টা পর রাত সাড়ে আটটার দিকে রোজিনাকে শাহবাগ থানা-পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তাকে রাত ৯টার দিকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।
পরে রাত পৌনে ১২টার দিকে তার বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করা হয়। মামলার বাদী হন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব শিব্বির আহমেদ ওসমানী।
দিনভর কারাফটকে সাংবাদিকরা
আজ বৃহস্পতিবার তার জামিন বিষয়ে শুনানি থাকায় সকাল থেকে কারাফটকে অবস্থান নেন সাংবাদিকরা। কিন্তু আজ তার জামিন হয়নি। শুনানি শেষে এ বিষয়ে আদেশ আগামী রোববার দিন ঠিক করে দিয়েছেন আদালত।
আদালতের এই সিদ্ধান্তে হতাশ হয়েছেন কাশিমপুর কারাফটকে রোজিনা ইসলামের জন্য অবস্থানরত সাংবাদিকরা। রোজিনা ইসলামের জামিন হবে এবং তিনি কারাগার থেকে মুক্ত হবেন- এমন প্রত্যাশায় সকাল থেকেই কারাফটকের সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা।
রোজিনার জামিন বিষয়ে শুনানির দিনে কাশিমপুর কারাফটকে ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। ফটকের সামনে মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য।
সকাল থেকে গাজীপুরের স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরাসহ ঢাকা থেকে বিভিন্ন টেলিভিশন, পত্রিকা ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকেরা জড়ো হতে থাকেন কারাফটকে। কিন্তু বিকালে জানা গেল আদালত রোজিনার জামিন বিষয়ে আদেশের দিন ধার্য করেছেন আগামী রোববার।
রোজিনা ইসলামকে হেনস্তার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে কারাফটকে অপেক্ষারত গণমাধ্যমকর্মীরা বলেন, রোজিনা ইসলামকে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানোর ঘটনাকে গণমাধ্যমের জন্য অশনিসংকেত। শুরু থেকে এই মামলার কোনো ভিত্তি নেই। রোজিনা ইসলামকে আটক করা মামলা স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপরে নগ্ন হস্তক্ষেপ। তার বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। রোজিনা ইসলামকে হেনস্তাকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
তারা আরও বলেন, রোজিনা ইসলামের মতো অনুসন্ধানী সাংবাদিকর জন্য কারাগারের সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে, এটি লজ্জাজনক। তাকে হেনস্তা ও জেল-জুলুম কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। রোজিনা ইসলামের মামলা প্রত্যাহার ও তাকে হেনস্তাকারীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থাকবেন মাঠের সাংবাদিকেরা।
ইআরএফের প্রতিবাদ সমাবেশ
আজ বৃহস্পতিবার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশ করেন সাংবাদিক নেতারা। সেখানে তারা বলেন, প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে নির্যাতন ও নিপীড়নের মাধ্যমে সাংবাদিকদের এই বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, ভবিষ্যতে কেউ যেন স্বাস্থ্য খাতের কালো বিড়াল বের করতে না আসে। রোজিনা ইসলামের ঘটনা প্রমাণ করে, সেটি ছিল পরিকল্পিত।
ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সাংবাদিক নেতারা আরও বলেন, সামনের দিনে যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে, সে জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সাংবাদিকেরা যদি তাদের অবস্থান ধরে রাখতে না পারেন, তাহলে স্বাধীন সাংবাদিকতা অস্তমিত হবে।
এ সময় ইআরএফের সাবেক সভাপতি জাকারিয়া কাজল বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আমলা নয় মানুষ হও। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে মানুষ নয়, আমলারা দানব হিসেবে তৈরি হচ্ছেন। এর জন্য তিনি জনপ্রতিনিধিদের দায়ী করেন। জাকারিয়া কাজল বলেন, এখন জনপ্রতিনিধিরা আমলাদের রক্ষার কাজ করছেন। এখন আমলারা জনপ্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণ করছেন।
ইআরএফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, রোজিনা ইসলামের প্রতিবেদনের কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারাই ষড়যন্ত্র করেছেন। সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে যেসব কালো আইন রয়েছে, সেসব বাতিলের দাবি জানান তিনি।
সিনিয়র সাংবাদিক নজরুল ইসলাম মিঠু বলেন, কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা রোজিনা ইসলামকে ফাঁসিয়েছেন। যারা রোজিনা ইসলামকে হেনস্তা ও নির্যাতন করেছেন, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। একজন সরকারি কর্মকর্তা একজন নাগরিককে কীভাবে হেনস্তা করেন? এটা কোন ধরনের সভ্যতা? সাংবাদিকদের সুরক্ষার জন্য সব কালো আইন বাতিল করতে হবে।
ইআরএফ সভাপতি শারমিন রিনভী বলেন, সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের নামে মামলা প্রত্যাহার ও নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানাচ্ছি। অফিশিয়াল সিক্রেটস আইন বাতিল করতে হবে। রোজিনা ইসলামের মুক্তি দেওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে জানান তিনি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ