বিপ্লব পাল
গত কুড়ি বছর ধরে লেখালেখির জীবনে, যে ইস্যুটা ২০০১ সালে যা ছিল, আজ ও তাই আছে-একটুও এগোয় নি — সমাধানের দিকে যায় নি-সেটা হচ্ছে ইস্রায়েল-প্যালেস্টাইন বিবাদ। মাদার অফ অল কনফ্লিক্ট।
আপনি কার পক্ষ নেবেন? যদি আপনি ইসলামিস্ট বা ইসলাম বিরোধি হোন, তাহলে পক্ষ আপনি নিয়েই নিয়েছেন!
এবার ধরুন, আমি ভাবলাম, ঠিক আছে একটু নিরেপেক্ষ ভাবে এই বিবাদটার গভীরে ঢুকে দেখি। ইহুদি-ইসলাম- প্যালেস্টাইনের ইতিহাস একদম এসেরিয়ান-পার্শিয়ান-রোমান-ইসলামিক-অটোমান-বৃটিশ হয়ে অধুনা ইস্রায়েল পর্যন্ত-অনেক পড়াশোনা করলাম। ডকুমেন্টারি দেখলাম। এবং নিরেপেক্ষ ভাবে চিন্তা করেছি -কি সিদ্ধান্তে আসা যায়!! কার পক্ষ নেওয়া যায়!!!
তাতে বুঝলাম, এই জাতি ধর্ম পরিচিতি ভিত্তিক রাজনীতি একধরনের ট্রাইবালিজম। আপনি এক্ষেত্রে ইস্রায়েল বা প্যালেস্টাইন-যারই সমর্থক হোন না কেন-খুব অজান্তেই এই জাতি ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি- দাঙ্গার রাজনীতিকে প্রশয় দিচ্ছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে এই অঞ্চল অটোম্যানদের হাত থেকে বৃটিশদের হাতে আসে। তখন থেকেই ইহুদি এবং প্যালেস্টাইন আরবরা একে অপরকে মারার জন্য একাধিক জঙ্গি বাহিনী গড়ে তোলে। যেহেতু ইহুদিরা ছিল ইউরোপ থেকে আগত-চিন্তাধারায় অনেক বেশী উন্নত- লন্ডন-নিউয়ার্কের ইহুদিদের টাকায় পুষ্ট- ইহুদি জঙ্গি বাহিনী হাগনা, ইরগ্রাম, লেহি ইস্রায়েল গঠনের কাজ বৃটীশ আমলেই শুরু করে দেয়।
উলটো দিকে প্যালেস্টাইন আরবরাও বৃটিশরা গেলে ইহুদিদের মেরা তাড়াব-কারন আমরা ৯৫% -এই ধান্দায় সমস্ত মুসলমানদেশের কাছ থেকে অস্ত্র সাহায্য পাচ্ছিল। যখন দুই পক্ষই বিংশ শতাব্দির শুরু থেকে ঠিক করে নিয়েছে সহাবস্থান সম্ভব না- অন্যকে মেরে খুন করে, দাঙ্গাবাজি করে তাড়াব-তখন, যে গৃহযুদ্ধে জিতবে, সেই দখল নেবে। পরাজিতদের মাটি ছাড়তে হবেই!
যেমনটা আমাদের দেশভাগের সময় হয়েছে। পাকিস্তান বাংলাদেশ ভূখন্ডে মুসলীম লীগের দাঙ্গাবাজরা খুন ধর্ষন করে হিন্দুদের তাড়িয়েছে। ইহুদিরা আরবদের তাড়িয়ে ইস্রায়েল তৈরী করছে। শুধু পার্থক্য হল বাংলাদেশ পাকিস্তানের ৬০-৮০% সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা বাকী ৪০-২০% হিন্দুদের তাড়িয়েছে। আর ইস্রায়েলে মাত্র ৫% ইহুদিরা বাহুবলে ৯৫% প্যালেস্টাইন মুসলমানদের তাড়িয়েছে তাদের স্বভূমি থেকে! অবশ্যই বন্দুকের নলের সামনে।
যুক্তি, ডিপ্লোমাসি, হিউম্যান রাইট-দুই পক্ষ কোন দিনই মানে নি-এবং তার ইতিহাস ইস্রায়েল গঠনের অনেকদিন আগে থেকেই। এখন দুই পক্ষই যদি বলে তারা জঙ্গলের আইনে বিশ্বাসী-সভ্য জগতের আইনে না- তাহলে আপনার আমার আর কি বলার থেকে? দুইপক্ষই বাহুবলে বিশ্বাসী হলে, বাকী বিশ্বের দর্শক হওয়া ছাড়া উপায় কি?
প্যালেস্টাইনের আরবদের কান্নাকে গুরুত্ব দেওয়ার কোন কারন দেখি না। কারন এরা ১৯২০ সাল থেকেই ইহুদিদের সম্পূর্ন ভাবে ধ্বংস করার জন্য যুদ্ধ করে আসছে। তিনটে বড় যুদ্ধ করেছে ৬ টা ইসলামিক দেশ মিলে ইস্রায়েলকে ধ্বংস করার জন্য। যুদ্ধ এবং হিংসাকে সমাধান ভাবলে- প্রতিহিংসাকে মানা ছাড়া উপায় নেই। শান্তির আবেদন , মানবতার আবেদন তাদেরই মানায়, যারা সেটা দেখাতে পেরেছে। আমরা রকেট ছুড়ে ইহুদি মারলে সেটা ধর্মীয় জিহাদ-গোটা মুসলমানবিশ্ব উল্লাস করবে-আর ইস্রায়েল পালটা মার দিলে -গোটা বিশ্ব আমাদের কেন সাপোর্ট করছে না-কেন ইস্রায়েলকে জঙ্গী রাষ্ট্রের তকমা দিচ্ছে না-সেই বলে নাকি কান্না কে শুনবে? গাজাতে হামাস এতটাই প্রতিশোধমুখী যে জল নেই, আলো নেই, খাদ্য নেই, হাসপাতাল নেই-তবুও ওখানে মহিলা প্রতি সন্তান ৪ থেকে ৮ জন। এই সব জিহাদি মহিলাদের আশা যে সন্তান বড় হয়ে ইস্রায়েলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদি জিহাদি হয়ে ইসলামিক পুন্য করবে! অন্যদিকে ইহুদিরাও কম হিংস্র না। তারা চাইছে ইস্রায়েলের সেনাবাহিনী গাজার সমস্ত অধিবাসীদের ওপর আক্রমন চালিয়ে গণনিধন করুক! ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং গাজার সমস্ত জমি তারা ছলে বলে অর্থ দিয়ে দখল করতে চাইছে।
এই সংঘর্ষ দেখলে মনে হয়, মানুষ আর মানুষ নেই। জানোয়ার হয়ে লড়াই করছে।
ইস্রায়েল প্যালেস্টাইন আরবদের বসতভূমি ছিল, সুতরাং ইহুদিদের ইস্রায়েল গঠন সম্পূর্ন অনৈতিক, সাম্রাজ্যবাদি শক্তির মদতপুষ্ট- সেটা ১০০% ঠিক। কিন্ত ওই যুক্তি মানতে গেলে বাংলাদেশ ও একদা হিন্দুদের বাসভূমি ছিল-বৃটিশদের চক্রান্তে আজকে তা আলাদা মুসলমান রাষ্ট্র।
এবার যদি সেই যুক্তিতে বিজেপি সেনা নামিয়ে বাংলাদেশের মুসলমানদের খেদিয়ে হিন্দুদের বসায়-আপনারা মানবেন?? ঠিক যে ঐতিহাসিক কারনে বাংলাদেশ আজ বৈধ মুসলমান রাষ্ট্র- ঠিক একই কারনে ইস্রায়েল বৈধ ইহুদি রাষ্ট্র। কোন ধর্মের লোকেদের ওটা আদি বাসভূমি ছিল- সেটা মানতে গেলে বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর ২৩টা রাষ্ট্র থেকে সব লোক তাড়িয়ে দিতে হয়। সুতরাং যে ঐতিহাসিক যুক্তিতে বাংলাদেশের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা বৈধ, সেই যুক্তিতে ইস্রায়েলের ইহুদি গরিষ্ঠতাও বৈধ।
ওগুলো নিয়ে আজকে ভেবে লাভ নেই। আমাদের আগামী দিনের দিকে তাকাতে হবে। যেখানে মুসলমান ইহুদি হিন্দু খ্রীষ্ঠান থাকবে না। মানুষ থাকবে। মানবাধিকার থাকবে । বিজ্ঞান থাকবে। সেদিন না আসা পর্যন্ত জোর যার মুলুক তার চলতে থাকবে। যদ্দিন মানুষ নিজেকে মুসলমান হিন্দু ইহুদি ইত্যাদি ভাবতে থাকবে এই ধরনের হিংসা আর যুদ্ধ চলতেই থাকবে।
ইস্রায়েল প্যালেস্টাইন সংঘাত আমাদের সেই শিক্ষা দেয়।
মতামত ও বিশ্লেষন বিভাগে প্রকাশিত সকল মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি State Watch এর সম্পাদকীয় নীতির আদর্শগত অবস্থান ধরে নেওয়া ঠিক হবে না। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, স্টেটওয়াচ কর্তৃপক্ষের নয়।
আপনার মতামত জানানঃ