বাকী বিল্লাহ
কালো বোরখায় নারীর শরীর, মুখ সম্পূর্ণ ঢেকে রাখা পোশাকটার ধারণা আর হিজাব এক নয়। মাথার চুল ঢেকে রাখা স্কার্ফটার ধারণার সাথে হিজাব মেলে, আক্ষরিকভাবেও ওই স্কার্ফটাকে হিজাব বলা হয়। কোরান-হাদিসের কোথাও নারীর মুখ ঢাকতে বলা হয়নি। বস্তুত আপাদমস্তক মোড়ানো বোরখা ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগের বর্বর পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির অংশ। নবীর মক্কা বিজয়ের পরে রাজনৈতিক কারণে মন থেকে না মেনে যে বংশগুলি ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, (মূলত উমাইয়ারা) তাদের প্রভাবেই মূলত জাহেলি যুগের কট্টর পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতিগুলো ইসলামে অনুপ্রবেশের সুযোগ পায়।
আর এই মুহূর্তে গাজায় ইজরায়েলের বর্বর আক্রমণে প্যালেস্টাইনীদের নির্বিচারে খুন হওয়ার প্রতিবাদ করতে গিয়ে আপাদমস্তক বোরখা আবৃত দুই সংগ্রামী প্যালেস্টাইনী নারীর ছবি যে সিম্বলিক হয়ে দাঁড়ালো– আমাদের সবার ওয়ালে ওয়ালে পোস্ট হচ্ছে; এই বাস্তবতার আদি স্রষ্টা স্বয়ং ইজরায়েল রাষ্ট্র। এরকম একটি ভবিষ্যত তৈরির জন্য তারা বহুবছর ধরে সুচতুরভাবে কাজ করে আসছে। জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ জিভ স্টারনেলের মতে, “ইস্রায়েল ভেবেছিল যে ফিলিস্তিনের মুক্তি সংস্থা (পিএলও) এর বিরুদ্ধে ইসলামপন্থীদের লেলিয়ে দেওয়াটা হবে তাদের সবচেয়ে স্মার্ট চালাকি”।
সেই লেলিয়ে দেওয়ার কাজটা শুরু হয়েছিল আজ থেকে অনেক বছর আগে।সত্তরের দশকে কায়রো থেকে ফিরে ফিলিস্তিনে ইসলামী আন্দোলনের আধ্যাত্মিক নেতা আহমেদ ইয়াসিন একটি ইসলামী দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইয়াসির আরাফাতের ফাতাহ আন্দোলনের নেতৃত্বাধীন পিএলও গড়ে উঠেছিল বামপন্থী গেরিলাদের শক্তির উপর ভর করে। ইজরায়েলের সামরিক আগ্রাসনের বিপরীতে সহিংস জবাব দেয়ার কার্যকর শক্তি গড়ে তুলেছিল তারা। প্যালেস্টাইনের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ও পিএলওর সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল। গোটা বিশ্বে বিপুল জনমত ও সমর্থন গড়ে উঠেছিল পিএলওর পক্ষে। খোদ ইজরায়েলেও ৭০ শতাংশ মানুষ ওই সময়ে প্যালেস্টাইনে সামরিক আগ্রাসনের ঘোর বিরোধী ছিল, তারা ভারসাম্যমূলক শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে ছিল। ইজরায়েলের জায়নবাদী ও ডানপন্থীদের জন্য পরিস্থতি একদম অনুকূল ছিল না, তাদের দরকার ছিল ভিন্ন কিছু।
ইজরায়েলের চোখে নিষিদ্ধ পিএলও, বিশেষত বামপন্থীদের টার্গেট করে যখন ব্যাপক দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছিল—ওই একই সময়ে শেখ ইয়াসিনের নেতৃত্বে এবং ইজরায়েলের সহায়তায় একের পর এক ইসলামী দাতব্য সংস্থা গড়ে উঠতে থাকে। ১৯৭৮ সালে গাজায় ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়। এসব দাতব্য সংস্থা ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল ঢুকতে ইজরায়েল প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও অনুমোদনের নীতি নেয়। ইজরায়েলের সামরিক কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত ছিল, এই কার্যক্রমগুলো গাজায় পিএলও ও বামপন্থী উভয়কেই দুর্বল করে দেবে। ১৯৮৭ সালের অক্টোবরে প্যালেস্টাইনিদের প্রতিরোধ অভুত্থান (ইন্তিফাদা) চলাকালে শেখ ইয়াসিন হামাস প্রতিষ্ঠা করেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে শুরু থেকেই হামাস তার শক্ত সাংগঠনিক ভিত্তির প্রমান রাখে।
১৯৯২ সালে গাজায় ফাতাহ ও বামপন্থীদের নির্মুল করার জন্য নিষ্ঠুর ক্র্যাকডাউন চালাচ্ছিল। তখন ৬শর কাছাকাছি মসজিদ ছিল গাজায়, যার সবই মোটামুটি হামাসের নিয়ন্ত্রণে ছিল। মসজিদগুলো সহ ইসলামীপন্থীদের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলগুলোতে মোসাদের শক্তিশালী উপস্থিতি ও নেটওয়ার্ক ছিল। মোটা দাগে ফাতাহ বা বামপন্থীদের দমন-পীড়নের কাজে খুবই সহযোগিতামূলক মনোভাব বিরাজমান ছিল মোসাদ ও ইসলামপন্থীদের মধ্যে।
পরবর্তী সময়গুলোতে হামাস পুরোপুরি ইজরায়েল বা মোসাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল এমনটা নয়। তবে যে পারপাসে হামাস গড়ে তুলতে ইজরায়ের সহযোগিতা করেছিল—সেই পারপাস পুরোপুরিই সার্ভ করে চলছিল তারা। প্রথম পারপাস ছিল ইসলামপন্থীদের উত্থানের মধ্য দিয়ে সেকুলার পিএলও ও বামপন্থীদের ঘায়েল করা। দ্বিতীয় পারপাস ছিল, প্যালেস্টাইনে এমন একটি গোষ্ঠীকে মূলধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যারা যেকোনো ধরণের শান্তি প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে থাকবে। এতে করে, ইজরায়েলের ক্রমবর্ধমান ভূমি দখল ও নতুন নতুন বসতি প্রক্রিয়ার জাস্টিফিকেশন তৈরি হবে। কোনো ধরণে শান্তি চুক্তিতে গেলেই তো তাদের ভূমি আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ পারপাস হলো, ইজরায়েলের ভেতরে বামপন্থী ও উদার রাজনৈতিক শক্তি ও ভয়েসগুলোকে দুর্বল করে শক্তিশালী আগ্রাসী ডানপন্থী শক্তিকে নিরংকুশ করা। হামাস এই সবগুলো পারপাসকেই সবসময়ে বাস্তবায়ন করে এসেছে, এখনো করছে।
১৯৯৩ সালে ইজরায়েল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে অসলো শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে ভূমি দখল বন্ধ ও স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির রূপরেখা ছিল। হামাস অসলো শান্তিচুক্তি সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে। ইজরায়েলের ভেতরেও চুক্তিবিরোধী কট্টররা তীব্র চাপ তৈরি করছিল। ইজরায়েলি ও প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষ উভয়ে মিলে প্যালেস্টাইনের জাতীয় কাউন্সিলের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ঘোষণার নির্ধারিত তারিখের ঠিক আগের দিন হামাস ইজরায়েলের বেসামরিক নাগরিকদের উপর আক্রমণ চালায়। এটিকেই পুজি করে ইজরায়েলের চুক্তিবিরোধী ডানপন্থীরা। মূলত ওই ঘটনার প্রভাবেই ১৯৯৬ সালের মে মাসে ইজরায়েলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ডানপন্থীরা সরকার গঠন করে। দু-দিকেই সংঘাতপন্থীরা শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। ওই সময়েও ইজরায়েলের কট্টরপন্থী শক্তির সাথে হামাসের গোপন সহযোগিতা অব্যাহত ছিল বলে ধারণা করা হয়।
ইজরায়েলি ও মার্কিন কর্তৃপক্ষের সাথে দরকষাকষিতে ইয়াসির আরাফাত তখন চরম বেকায়দায় পড়ে আছেন। একদিকে বিল ক্লিনটন ও নেতানিয়াহু হামাসকে নিয়ন্ত্রণের জন্য আরাফাতকে চাপ দিচ্ছিলেন, অন্যদিকে নেতানিয়াহু ঠিকই জানতেন যে অসলো শান্তিচূক্তি ভেস্তে দেয়ার জন্য তাকে খুব বিশেষ কিছু করতে হবে না। ওর জন্য তিনি হামাস ও অন্য ইসলামপন্থী গ্রুপগুলোর উপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করতে পারেন। আরাফাত আরো বেকায়দায় পড়েন ১৯৯৯ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ে। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আরাফাত এই যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনের পক্ষ নিয়েছিলেন। হামাস কৌশলে পক্ষ নেয়া থেকে বিরত থাকে। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং এই যুদ্ধে তার সহযোগী সৌদি আরব, কুয়েত, কাতারের মত দেশগুলো ইয়াসির আরাফাত থেকে একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। তারা প্যালেস্টাইনি কর্তৃপক্ষের অর্থায়ন পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে ওই একই সময়ে শেখ আহমেদ ইয়াসিন ওই একই দেশগুলি থেকে কয়েকশ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই তহবিল হামাস এবং র্যাতডিকাল ইসলামী দাতব্য সংস্থাগুলোকে ব্যাপক শক্তিশালী করে তোলে। হামাসের বাজেট প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষের বাজেটের চেয়েও বেশি হয়ে দাঁড়ায়।
হামাস শক্তিশালী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগীর নাম ইজরায়েল। অসলো শান্তি চূক্তিকে ব্যর্থ না করে দিতে পারলে একটি স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কোনোভাবেই আটকানো সম্ভব ছিল না। একদিকে আন্তর্জাতিক চাপ এবং একই সাথে ইজরায়েলের ভেতরে স্বাধীন প্যালেস্টাইন গঠনের পক্ষে যে বিপুল জনমত এবং চাপ—তাকে নিস্ক্রিয় করে ইজরায়েলের দখলদারিত্ব, বিশেষত ক্রমাগত প্যালেস্টাইনিদের ভূমি দখলের যে প্রক্রিয়া; তা অব্যাহত রাখতে হামাস বা আজকের ইসলামিক জিহাদ দারুণভাবে ভূমিকা রেখে চলেছে। ইসলামপন্থী হামাস বা ইসলামিক জিহাদ জায়নবাদী উদারবাদী নির্বিশেষে সকল ইহুদীকেই একই চোখে দেখে। তারা এদের সকলকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। আজকে এরাই যখন প্যালেস্টাইনের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূলধারায় পরিনত হয়েছে তখন ইজরায়েল রাষ্ট্রের উপর শান্তি প্রতিষ্ঠার যে বিপুল চাপ ছিল, তা অনেকখানিই উধাও হয়ে গেছে। অন্তহীন সংঘাত এবং মৃত্যু ছাড়া প্যালেস্টাইনে আর কোনো পথ আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
সংকটটা একদিনের না, কয়েক হাজার বছরের। পুরোনো পৃথিবীর অনেককিছুই বদলে গেছে, কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে এন্টিক সংকটটি জেরুজালেমকে ঘিরে আজো বিদ্যমান। আগামীকাল পবিত্র ইদুল ফিতর, সেমেটিকদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। সেই উৎসবের প্রাক্কালে দুনিয়ার সকল মুসলমান ও ইব্রাহিমের পূত্রদের শুভবুদ্ধির উদয় কামনা করি। হাজার হাজার বছর চলে গেছে, দিন-দুনিয়ার জ্যামিতি কত আশ্চর্যজনকভাবে বদলে গেছে; কিন্তু এরা এখনো বদলাতে শেখে না। একজন আরেকজনকে সহ্য করে না। আর কতদিন!
মতামত ও বিশ্লেষন বিভাগে প্রকাশিত সকল মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি State Watch এর সম্পাদকীয় নীতির আদর্শগত অবস্থান ধরে নেওয়া ঠিক হবে না। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, স্টেটওয়াচ কর্তৃপক্ষের নয়।
আপনার মতামত জানানঃ