বিশেষ প্রতিবেদক : এই মার্চ মাসে মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ। প্রতিদিনই উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে করোনা সংক্রমণের হার। প্রতিদিন হচ্ছে সর্বোচ্চ সংক্রমণের নতুন রেকর্ড। হাসপাতালের সাধারণ ও আইসিইউ শয্যার জন্য দীর্ঘ লাইন। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। এই সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের নমুনায় পাওয়া গেছে যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন স্ট্রেইন, সেই জানুয়ারিতেই। আইসিডিডিআরবি জানায়, ডিসেম্বরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং আইইডিসিআরের সঙ্গে করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ভ্যারিয়ান্টের ওপর নজরদারি শুরু করে তারা। দেশটিতে শনাক্ত করোনা ভাইরাসের ধরনগুলোর মধ্যে এখন ৮১ শতাংশই দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট।
কীভাবে এই নতুন স্ট্রেইন?
যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির যুক্তরাজ্য সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম বলেন, করোনা ভাইরাস এক ধরণের আরএনএ ভাইরাস। এটি প্রাকৃতিকভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জেনেটিক মিউটেশনের মাধ্যমে রূপ পরিবর্তন করে এবং এভাবেই জন্ম দেয় নতুন স্ট্রেইন বা ভ্যারিয়েন্টের। রূপান্তরিত স্ট্রেইনগুলো অনেক সময় আগের চেয়ে বেশি সংক্রামক ও মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এসব পরিবর্তন ভাইরাসকে মানুষের মাঝে দীর্ঘদিন টিকে থাকার সক্ষমতা দিয়ে থাকে।
“স্পাইক প্রোটিনে মিউটেশনের কারণে ভাইরাসগুলো টিকা প্রতিরোধীও হয়ে উঠতে পারে।”
করোনা ভাইরাস এতোটা সংক্রামক হওয়ার কারণ এর স্পাইক প্রোটিনগুলো। ভাইরাসের খোলসে থাকা স্পাইক প্রোটিনের মাধ্যমে মানব কোষের সঙ্গে আটকে যায় এটি। স্পাইক প্রোটিনের একটি ক্ষুদ্র অংশের নাম ‘রিসিপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইন’। এই অংশটির মাধ্যমেই মূলত ভাইরাসটি মানব কোষে থাকা নির্দিষ্ট রিসেপ্টর এসিই২’র সঙ্গে বন্ধন সৃষ্টির মাধ্যমে সংক্রমণ করে রোগ সৃষ্টি করে, যা কোভিড-১৯ নামে পরিচিত।
রিসিপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইনে যেকোনো পরিবর্তন ভাইরাসটির সংক্রমণ সক্ষমতা বাড়াতে পারে। যে সব ভ্যাকসিন স্পাইক প্রোটিনকে টার্গেট করে বানানো হয়েছে, স্পাইক প্রোটিনে মিউটেশনের কারণে ভাইরাসগুলো ভ্যাকসিন প্রতিরোধীও হয়ে উঠতে পারে।
ইউকে ভ্যারিয়েন্ট মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ায় ৬১ শতাংশ
গত বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে বি.১.১.৭ নামক একটি নতুন স্ট্রেইন শনাক্ত করা হয়। যা ডিসেম্বরের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। যুক্তরাজ্যের এই নতুন স্ট্রেইন দিয়েই ভয়াবহ দ্বিতীয় ঢেউটি হয়। যার ফলে প্রাণ হারায় প্রায় ৮৫ হাজার মানুষ।
বি.১.১.৭ স্ট্রেইনটির স্পাইক প্রোটিনে প্রধানত একটি ডিলিশন (এইচভি৬০/৭০ ডেল) এবং এন৫০১ওয়াই ও পি৬৮১এইচ নামক দুইটি মিউটেশন একত্রে সংঘটিত হয়, যার ফলে ভাইরাসটির সংক্রমণ ক্ষমতা বেড়ে যায় ৭০ শতাংশ এবং গুরুতরভাবে অসুস্থ করার ক্ষমতা বেড়ে যায় ৩০-৪০ শতাংশ। এ ছাড়াও এই স্ট্রেইন দিয়ে যারা সিভিয়ার কোভিডে আক্রান্ত হয়, তাদের মধ্যে মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায় আগের চেয়ে ৬১ শতাংশ।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকাসহ অন্যান্য টিকা এই স্ট্রেইনের ওপর কার্যকরী হলেও, অতিসংক্রমণশীলতার কারণে এই নতুন স্ট্রেনইটি বিশ্বব্যাপী মহামারি নিয়ন্ত্রণে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি জার্মানি ও ফ্রান্সসহ গোটা ইউরোপে মহামারির দ্বিতীয় ঢেউটির কারণও এই ইউকে ভ্যারিয়েন্ট। ইউকে স্ট্রেইনটি বাংলাদেশ ও ভারতসহ প্রায় ১০৯টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্ট: অকার্যকর টিকা
করোনাভাইরাসের আরেকটি বিপজ্জনক ভ্যারিয়েন্ট হলো বি.১.৩৫১, যা দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্ট নামে পরিচিত। এই স্ট্রেইনটির স্পাইক প্রোটিনে এন৫০১ওয়াই ও ই৪৮৪কে নামক দুটি প্রধান মিউটেশন ঘটেছে। এখন পর্যন্ত এই স্ট্রেইনটি ৬৮টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
দুটি মিউটেশন স্পাইক প্রোটিনের রিসিপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইন অংশে খুব কাছাকাছি সংঘটিত হওয়ার কারণে বি.১.৩৫১ স্ট্রেইনটি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে ফাঁকি দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে।
এর ফলে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা এই স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ফাইজার ও জনসন অ্যান্ড জনসনসহ অন্যান্য টিকাগুলোও এই স্ট্রেইনটির বিরুদ্ধে আংশিক কার্যকারিতা হারিয়েছে।
আরও একটি ভয়ংকর স্ট্রেইনটি হলো পি.১, যা ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্ট নামে পরিচিত। এই স্ট্রেইনটির স্পাইক প্রোটিনে উল্লেখযোগ্য এন৫০১ওয়াই, ই৪৮৪কে ও কে৪১৭টি মিউটেশন ঘটেছে। এই স্ট্রেইনটির পুনঃসংক্রমণ ও দ্রুত বিস্তার ঘটানোর প্রবণতা রয়েছে। ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্ট এখন পর্যন্ত ৩৬টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি ব্রাজিলে করোনার ভয়াবহ বিস্তারের জন্য এই অতিসংক্রামক স্ট্রেইনটি দায়ী।
নতুন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশে অনিশ্চয়তা!
আইইডিসিআরের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মাত্র ৪৫০টি জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে। যার মাধ্যমে ৩০টি ইউকে ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.১.৭) ও দুটি দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.৩৫১) শনাক্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্ট পি.১ শনাক্ত হয়নি।
জিনোম সিকুয়েন্স রিপোজেটোরি (জিআইএসএআইডি) ডেটাবেইজে বাংলাদেশের পক্ষে এখন পর্যন্ত ১০টি ইউকে স্ট্রেইন ও পাঁচটি দক্ষিণ আফ্রিকা স্ট্রেইন শনাক্তের তথ্য জমা দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি বেশ কয়েকটি অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) ১২০টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করে। যার মধ্যে ইউকে ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে ৭০ শতাংশ। এই গবেষণার ফলাফল এখনো কোনো বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশ করা হয়নি কিংবা এর তথ্য জিআইএসএআইডির ডেটাবেইজে জমা দেওয়া হয়নি।
তবে, এই তথ্য যদি সঠিক হয় তাহলে তা অবশ্যই খুবই উদ্বেগজনক একটি সংবাদ। কোনো টেস্টে যদি ৭০ শতাংশ ইউকে স্ট্রেইন পাওয়া যায়, তাহলে তা থেকে ধারণা করা যায় যে ইউকে ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে দেশের ভেতরে।
করোনার নতুন স্ট্রেইন কি দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে?
বাংলাদেশে ইউকে স্ট্রেইনটি প্রথম শনাক্ত হয় গত ৬ জানুয়ারি, ঢাকার ৫০ বছর বয়সী একজন কোভিড রোগীর নমুনায়। আইসিডিডিআরবির একটি গবেষক দল পাঁচ হাজার ২৫০টি নমুনা পরীক্ষা করে এর মধ্যে একটি ইউকে স্ট্রেইন শনাক্ত করে। যার সঙ্গে বি.১.১.৭ ভ্যারিয়েন্টের ৯৯ শতাংশ মিল ছিল।
এই প্রতিবেদনটি গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ‘মাইক্রোবায়োলজি রিসোর্স অ্যানাউন্সমেন্ট’ জার্নালে প্রকাশিত হয়। তবে, এই নমুনাগুলো ভ্রমণকারীদের কাছ থেকে নাকি কমিউনিটি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল, সেই তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
বাংলাদেশে বর্তমান সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির পেছনে যুক্তরাজ্যের ‘ইউকে স্ট্রেইন’ দায়ী কি না, তা নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও, বর্তমান সংক্রমণের গতি, বিস্তার, শনাক্তের হার, ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের সংখ্যার দ্রুত বাড়া, হাসপাতালের শয্যা কোভিড রোগীতে ভর্তি হয়ে যাওয়া, তরুণদের আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া— এসব কিছু মিলিয়ে এটি অনুমান করা যায় যে ইউকে স্ট্রেইনটি হয়তো দেশের জনগণের ভেতর ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলগুলোতে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিধ্বস্ত বাংলাদেশ
দেশের সর্বত্র নতুন স্ট্রেইনগুলো ছড়িয়ে পড়ছে কি না, এই অনিশ্চয়তার ভেতরেই বাংলাদেশে গত সাত দিন ধরে দৈনিক করোনা সংক্রমণ পাঁচ থেকে সাত হাজারের মধ্যে রয়েছে। গতকালও নতুন শনাক্তের সংখ্যা সাত হাজার ছাড়িয়েছে। গত সাত দিনের শনাক্তের হার গড়ে ২০ শতাংশের বেশি। ফেব্রুয়ারিতে যা ছিল আড়াই শতাংশের মতো। গত চার সপ্তাহের মধ্যে শনাক্তের হার তিন শতাংশ থেকে বেড়ে ২৩ শতাংশে দাঁড়ায়।
গত চব্বিশ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৭৪ জন। এর মধ্যে চার জন বাড়িতে আর বাকি সবাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে।
যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে ৪৮ জন পুরুষ ও ২৬ জন নারী। এ নিয়ে বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর সংখ্যা সাড়ে নয় হাজার ছাড়ালো। অন্যদিকে এ সময়ে অর্থাৎ গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ৬,৮৫৪ জন।
মার্চের শুরুতে যখন দ্বিতীয় ঢেউয়ের সূচনা হয়, তখন দৈনিক সংক্রমণ শনাক্ত সংখ্যা ছিল প্রায় ৫৫০, যা মাত্র ৩৫ দিনের মধ্যে বেড়ে যায় ১৩ গুণ। এই সময়ের ভেতরে দেশে যুক্ত হয় আরও নব্বই হাজারেরও বেশি নতুন কোভিড রোগী। কিন্তু, গত বছর মহামারির প্রথম ঢেউয়ের শুরুর সময় নব্বই হাজার কোভিড শনাক্তে সময় লেগেছিল প্রায় সাড়ে তিন মাস।
দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় নয় শ জন মারা গেছে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে। গত ৩৫ দিনে প্রতিদিনের মৃত্যু সংখ্যা ৭ থেকে সর্বোচ্চ ৬৬-তে পৌঁছেছে। গুরুতর কোভিড নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ শয্যা খালি পাওয়া যাচ্ছে না। সংক্রমণ ক্রমাগত বাড়া ও হাসপাতালে শয্যা না পাওয়ার কারণে এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে শেষ সপ্তাহের মধ্যে দৈনিক মৃত্যু তিন-অঙ্কের ঘরে পৌঁছে যাওয়া অনেকটাই অবশ্যম্ভাবী। মনে রাখা দরকার যে করোনার সংক্রমণ বাড়া ও এর ফলস্বরূপ মৃত্যুর মধ্যে দুই সপ্তাহের ব্যবধান রয়েছে।
রিপ্রোডাকশন রেট
আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা ওয়েবসাইটের তথ্য মতে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সর্বশেষ (১ এপ্রিল) রিপ্রোডাকশন রেট (আর০) হচ্ছে ১ দশমিক ৫৪, যা চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির চেয়ে ৮৮ শতাংশ বেশি। ফেব্রুয়ারিতে করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণেই ছিল। রিপ্রোডাকশন রেট দিয়ে বোঝানো হয় যেকোনো নির্দিষ্ট সময়ে সংক্রমণ কত দ্রুত বাড়ছে। সহজভাবে বলতে গেলে, রিপ্রোডাকশন রেট দিয়ে বোঝা যায় যে একজন থেকে কত জন নতুন করে সংক্রামিত হচ্ছে। রিপ্রোডাকশন রেট একের বেশি হলে বোঝা যায় সংক্রমণ দ্রুত সমানুপাতিকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। আর রিপ্রোডাকশন রেট যদি একের কম হয়, তবে বোঝা যায় সংক্রমণ ধীরে ধীরে কমছে।
বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারিজুড়ে রিপ্রোডাকশন রেট ছিল গড়ে শূন্য দশমিক আট, যা মার্চের প্রথম সপ্তাহে বেড়ে হয় এক দশমিক ২১। গত ৫ জানুয়ারি যুক্তরাজ্য যখন তাদের মহামারির দ্বিতীয় ঢেউকে দমন করতে দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন ঘোষণা করতে বাধ্য হলো, তখন রিপ্রোডাকশন রেট ছিল এক দশমিক ২১, যা আমরা দেখেছি বাংলাদেশে মার্চের প্রথম সপ্তাহে। লকডাউন দিয়ে যুক্তরাজ্য এক মাসের মধ্যেই রিপ্রোডাকশন রেট কমিয়ে শূন্য দশমিক ৮ এর ঘরে নিয়ে আসে এবং সংক্রমণ বাড়ার ঊর্ধ্বগতিকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
রিপ্রোডাকশন রেটের মান বিবেচনা করে, বাংলাদেশের উচিত ছিল মার্চের প্রথম সপ্তাহেই কঠোর প্রশমনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। তবে তা না করে, দেওয়া হলো ১৮ দফা নির্দেশনা। যাতে ছিল কিছুটা স্ববিরোধী ও অস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত শর্ত। এ ধরনের প্রজ্ঞাপন বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে তেমন একটা কার্যকরী নয়। অবশেষে অবশ্য সরকার সোমবার থেকে দেশব্যাপী এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন ঘোষণা করেছে। তবে, এই লকডাউনও দুর্বল রাজনৈতিক দলের ডাকা হরতালের মতই ‘ঢিলেঢালা’ভাবে পালিত হচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
কী করা উচিত সরকারের?
যদি এটি সত্য হয়, সরকারের উচিত এই বিষয়টা খোলাসা করা এবং দেশে করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইনগুলোর সঠিক সংখ্যা ও দেশজুড়ে এর বিস্তৃতি সবাইকে জানানো।
গত ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্যে যখন ইউকে ভ্যারিয়েন্ট চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন কিন্তু সরকার এই ব্যাপারটা জনসমক্ষে এসে সবাইকে অবহিত করেছিল। এতে করে ভীতি নয়, বরং মানুষের ভেতর এক ধরনের সাবধানতা তৈরি হয়। আর এর ফলে দেশের জনগণ সরকারের নেওয়া কঠোর উদ্যোগগুলোর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে এবং তা বাস্তবায়নে সহায়তা করে।
পাশাপাশি সরকারকে এখনই কঠোর ও কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশে ‘স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করা যেতে পারে। এতে করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সকল স্তর সতর্কাবস্থায় থাকবে।
কঠোর লকডাউন!
যদিও সরকার এক সপ্তাহের জন্য দেশব্যাপী লকডাউন শুরু করেছে, তবে সম্ভবত এক সপ্তাহের লকডাউন সংক্রমণের বর্তমান ঊর্ধ্বগতি প্রশমনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। এ ধরনের সংক্রমণের তীব্রতা নিয়ন্ত্রণ করতে কমপক্ষে দুই থেকে তিন সপ্তাহের লকডাউন প্রয়োজন।
লকডাউন ছাড়াও সংক্রমণ কমাতে রাত্রিকালীন কারফিউ দেওয়া যেতে পারে। তবে, শুধু লকডাউন ঘোষণা করলেই কাজ হবে না। এর যথাযথ বাস্তবায়ন দরকার।
ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম মনে করেন লকডাউন যেরকম ঢিলেঢালাভাবে হচ্ছে, এরকম চললে তিন মাস লকডাউন দিয়েও কাজ হবে না।
লকডাউনে দরিদ্র, নিম্ন আয়ের মানুষেরা স্বভাবতই কাজ হারিয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই সময়টিতে কীভাবে তারা বেঁচে থাকবে এবং কীভাবে তারা তাদের পরিবারকে খাওয়াবে?
সরকারের উচিত এই প্রথম সারির ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ রেশন ও খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখা। বিশৃঙ্খলা এড়াতে ও সমাজের প্রতিটি কোণ থেকে লকডাউনের সমর্থনের জন্য এই বিষয়গুলোর দিকে নজর দেওয়া একান্ত জরুরি।
ক্রমবর্ধমান কোভিড রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করতে ঢাকাসহ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে ‘ফিল্ড হাসপাতাল’ স্থাপন করা উচিত। এ ছাড়াও সব কোভিড হাসপাতাল ও জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। অক্সিজেনের ব্যাপক চাহিদা মেটাতে কোভিড হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন জেনারেটর ও অক্সিজেন কনসেনট্রেটর সরবরাহ করতে হবে।
টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষা
দেশব্যাপী এখন মিউটেশন সার্ভেইল্যান্স শুরু করা জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি সব দেশকে ভ্যারিয়েন্ট সার্ভেইল্যান্স চালানোর আহ্বান জানিয়েছে। করোনা সংক্রমণ ও টিকার কার্যকারিতা মূল্যায়ন করার জন্য মিউটেশন সার্ভেইল্যান্স গুরুত্বপূর্ণ।
জিনোম সিকোয়েন্সিং নতুন মিউটেশন শনাক্তকরণ ও মিউটেশন সার্ভেইল্যান্সের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি। তবে এই কৌশলটি ব্যয়বহুল ও সময় সাপেক্ষ, যার জন্য দরকার বিশেষ দক্ষতা ও সক্ষমতা, যার অভাব স্পষ্টতই বাংলাদেশে রয়েছে।
বিকল্পভাবে থ্রি-জিন আরটি-পিসিআর কিট ব্যবহার করেও দেশে খুব সহজেই মিউটেশন সার্ভেইল্যান্স করা সম্ভব। এই পদ্ধতি ‘ইউকে স্ট্রেইন’ শনাক্তকরণে ৯৯ শতাংশ কার্যকরী। এই কিটটি ‘টেকপাথ কোভিড-১৯ কিট’ নামে পরিচিত।
বিখ্যাত থার্মোফিশার কোম্পানি বাণিজ্যিকভাবে এই কিট উৎপাদন করেছে। এই নির্দিষ্ট কিটটি পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড (পিএইচই) তাদের তিনটি লাইটহাউজ ল্যাবরেটরিতে বি.১.১.৭ ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তকরণের জন্য হাজারো নমুনায় ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে। পরবর্তীতে এই কিটটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কমিউনিটিতে মিউটেশন সার্ভেইল্যান্সের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
পিএইচই প্রকাশিত ‘টেকনিক্যাল ব্রিফিং ২’ অনুসারে, থ্রি-জিন আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় এস-জিন ড্রপআউট ‘ইউকে স্ট্রেইন’ শনাক্তে একটি ভালো প্রক্সি হিসেবে কাজ করে।
কতটা হার্ড ইমিউনিটির দিকে এগোলো বাংলাদেশ?
বাংলাদেশে মহামারির বয়স এক বছরেরও বেশি হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত কোভিডে আক্রান্ত হয়েছে সাড়ে ছয় লাখের বেশি মানুষ। টিকাদান কর্মসূচি চলছে দেশজুড়ে। এখনই সেরোসার্ভেইল্যান্সের সঠিক সময়।
অঞ্চলভিত্তিক ও নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেরোসার্ভেইল্যান্স না করলে হার্ড ইমিউনিটির দিকে দেশ কতটুকু এগোচ্ছে তা বোঝা যাবে না।।এ ছাড়াও, টিকা আমাদের দেশে মানুষের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি করছে কি না, সেটা জানাও জরুরি।
সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যে ৫৭ শতাংশ মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। এই এন্টিবডি তৈরি হয়েছে করোনা সংক্রমণ ও টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যাকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা হয়েছে। যুক্তরাজ্য কোভিডের বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তোলার দিকে এগিয়ে চলেছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫১৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ