বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত সাজা স্থগিত ও জামিনের মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ানো হয়েছে। আজ সোমবার(১৫ মার্চ) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দণ্ডের কার্যকারিতা আরও ছয় মাসের জন্য স্থগিত রাখার প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মতি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে করা আবেদন এবং আইন ও বিচার বিভাগের আইনগত মতামতের আলোকে খালেদা জিয়ার দণ্ডাদেশ শর্তসাপেক্ষে স্থগিত করা হয়েছে। ২৫ মার্চ থেকে পরবর্তী ছয় মাসের জন্য দণ্ড স্থগিত থাকবে।
এদিকে সোমবার একটি গণমাধ্যমকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের সাজা আরও ছয় মাসের জন্য স্থগিত রেখে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদন করেছেন। আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতও প্রস্তাবের সঙ্গে পাঠানো হয়েছিল।
এ ক্ষেত্রে দুটি শর্ত রয়েছে। শর্তানুযায়ী, মুক্ত থাকার সময়ে খালেদা জিয়াকে ঢাকায় নিজের বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না।
আইন মন্ত্রণালয় যে মতামত দিয়েছিল, সেখানে বলা হয়েছিল, খালেদা জিয়া দেশের ভেতরে বিশেষায়িত চিকিৎসা নিলে তাতে সরকারের আপত্তি নেই।
সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া নিজের পছন্দ অনুযায়ী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে পারবেন কিনা জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসা নিতে পারবেন বাসায় থেকে। হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলে যাবেন। তবে দেশে থেকে শর্ত মেনেই করতে হবে।
আগের শর্তে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য শুধু বিএসএমএমইউ হাসপাতালের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল, তবে বিএনপি ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসার কথা বারবার বলে আসছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের প্রশ্ন আসেনি। আমাদের এ শর্তে কোনো হাসপাতালের নাম উল্লেখ করা হয়নি। তিনি বাসায় অবস্থান করে যে কোনো চিকিৎসাসেবা নিতে পারবেন। যদি তার এক্সরে করার প্রয়োজন হয়, তখন তাকে হাসপাতালে গিয়ে এক্সরে করে আবার বাসায় ফিরতে হবে। ’
বিদেশ থেকে কোনো চিকিৎসক আসতে পারবেন কি না জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এগুলো নিয়ে আমাদের কোনো আলোচনা হয়নি। এ বিষয়ে আমাদের চিকিৎসকরা জানেন এবং অন্যরা জানেন এবং তিনি আবেদনও করেননি। তিনি নিজ বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন। যদি কোনো প্রয়োজন হয়, তখন তিনি হাসপাতালের সহযোগিতা নিতে পারবেন। ’
ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার উপধারা ১-এ খালেদা জিয়ার সাজা ছয় মাসের জন্য স্থগিত রেখে তাকে দেশের অভ্যন্তরে বিশেষায়িত চিকিৎসা নেওয়ার শর্তে এ মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না।
দুর্নীতির দুই মামলায় দণ্ডিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে গতবছর ২৫ মার্চ নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি দেয় সরকার। দণ্ডের কার্যকারিতা ছয় মাসের জন্য স্থগিত করা হলে তিনি কারামুক্ত হন।
ওই মুক্তির মেয়াদ শেষে গতবছর সেপ্টেম্বরে আগের শর্তে তা আরও ছয় মাসের জন্য বাড়ানো হয়। তখনও একই শর্ত দেওয়া হয়।
গত ২ মার্চ পরিবারের পক্ষ থেকে দেয়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দণ্ড স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানো, মওকুফ এবং শর্ত শিথিল করে বিদেশে পাঠানোর আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়। এই আবেদনের বিষয়ে মতামত দিতে তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
গত ৮ মার্চ খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ আগের শর্তে আরও ৬ মাস বাড়ানোর বিষয়ে মতামত দেয় আইন মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতসহ এ-সংক্রান্ত সার-সংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন বকশীবাজার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ আদালত। রায় ঘোষণার পর খালেদাকে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে অবস্থিত পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি রাখা হয়। এরপর ৩০ অক্টোবর এই মামলায় আপিলে তার আরও পাঁচ বছরের সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেন হাইকোর্ট।
একই বছরের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়াকে ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন একই আদালত। রায়ে ৭ বছরের কারাদণ্ড ছাড়াও খালেদা জিয়াকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানা অনাদায়ে আরও ৬ মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেন।
পরে কারান্তরীণ অবস্থায়ই চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে নেয়া হয় খালেদা জিয়াকে। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা শেষে তাকে আবারও কারাগারে পাঠানো হয়। এভাবে কয়েক দফায় তাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এবং হাসপাতাল থেকে কারাগারে নেয়া হয়।
মামলা দু’টি ষড়যন্ত্রমূলক বলার পাশাপাশি বিএনপি নেতারা খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য মুক্তির দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এক্ষেত্রে তারা আদালতেও আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বরাবরই বিফল হতে হয়েছে বিএনপির নেতৃত্বকে।
এর মধ্যে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে বিএনপি নেতারা খালেদার মুক্তির জোর দাবি তোলেন। পরিবারের পক্ষ থেকেও বেগম জিয়ার মুক্তির জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়।
সেই প্রেক্ষাপটে নির্বাহী আদেশে দণ্ড স্থগিত করে কারাবন্দি খালেদা জিয়াকে সরকার শর্তসাপেক্ষে ৬ মাসের জন্য মুক্তি দেয়। প্রথম দফা মুক্তির মেয়ার শেষ হয়ে আসলে গত বছরের ২৫ আগস্ট বেগম জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে স্থায়ী মুক্তি চেয়ে আবেদন করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার দ্বিতীয় দফায় গত ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ মাসের জন্য তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ায়।
৭৫ বছর বয়সী খালেদা জিয়া বর্তমানে গুলশানে তার ভাড়া বাসা ‘ফিরোজায়’ রয়েছেন। তিনি আর্থারাইটিসের ব্যথা, ডায়াবেটিস, চোখের সমস্যাসহ বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতির বিচার অবশ্যই হওয়া উচিত এবং সেটা দৃষ্টান্তমূলকভাবেই হওয়া উচিত। কিন্তু, দুর্নীতির বিচার কিংবা শাস্তি দেওয়া যদি কোনো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে দেওয়া হয়, তখন এখানে বড় করেই একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেখা দেয়। খালেদা জিয়া প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী, ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বলেই দুর্নীতির বিচার কড়ায় গণ্ডায় করে যাচ্ছে। অথচ সরকারদলীয় দুর্নীতিবাজ, অর্থপাচার ও ব্যাংক লুট করে ফেলার মতো আসামি হলেও তাদের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। নিজ দলের বেলায় চোখ বন্ধ আর বিরোধী দলের বেলায় যখন চোখ খোলা রেখে কড়ায় গণ্ডায় হিসাব আদায় করা হয়, তখন এই বিচার ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক কোনো বিচার চাই না। সংশ্লিষ্ট দোষে দোষী সকলেরই বিচার হওয়া উচিত। বিচারে বৈষম্য থাকলে উদ্দিষ্ট অপরাধ কমার কোনো প্রবণতা তৈরি হবে না। কেবল বিরোধীদল নয়, দুর্নীতির সাথে জড়িত সকলকেই বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করে আইনের সাম্যতা আনার আহ্বান জানান বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০৭
আপনার মতামত জানানঃ