মার্শা বার্নিকাট মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে ঢাকায় আসেন ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি এবং চার বছর এখানে দায়িত্ব পালন শেষে ২০১৯ সালের ২ নভেম্বর দেশে ফিরে যান। এর মধ্যে ২০১৮ সালের ৪ আগস্ট মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে তার গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটেছিল। সেই রাতে তিনি সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের বাসায় নৈশভোজে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে বের হওয়ার পর তার গাড়িতে অস্ত্রধারীরা হামলা চালায়।
২০১৮ সালের ১০ আগস্ট মোহাম্মদপুর থানায় করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আড়াই বছর পর তদন্ত শেষে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নাইমুল হাসান, ফিরোজ মাহমুদ, মীর আমজাদ হোসেন, শহিদুল আলম খান, তানহা ওরফে মুজাহিদ, সাজু ইসলাম, রাজীবুল ইসলাম ও মো. সিয়াম ও অলি আহমেদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।
চার্জশিটে নয় আসামিকেই পলাতক দেখানো হয়েছে। তবে আদালত সূত্র জানায়, তাদের মধ্যে তিন আসামি প্রথম থেকেই পলাতক ছিলেন। আর ছয় জন চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামিন পান।
পুলিশের অকপট মিথ্যাচার
অভিযুক্তদের কাউকেই পুলিশ আটক করতে পারেনি, কিন্তু অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ‘সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র হচ্ছে’ এমন মনে করেই আসামিরা হামলা চালিয়েছেন। বোঝা যায়, এখানেও অভিযুক্তদের মনোজগতে পরিভ্রমণ করে এসেছেন পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা। তবে সেটা তিনি করেছেন ‘সোর্সের’ মাধ্যমে।
তদন্তকারী কর্মকর্তা তেজগাঁও অঞ্চলের পরিদর্শক আবদুর রউফের ‘সোর্স’ নিশ্চিত করেছেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা মনে করেছিলেন, বদিউল আলম মজুমদারের বাসায় ‘সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে, তাই তারা সেই বাসা থেকে বের হওয়ার পর তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের গাড়িতে হামলা চালিয়েছেন।
আসামীদের টিকিটিও ছুঁতে পারছে না পুলিশ। কিন্তু গণমাধ্যমে আছে তাদের সরব উপস্থিতি। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের এমন তিনজন নেতা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও তদন্ত কর্মকর্তার পরিচয় দিয়ে না তাদের কাছে ফোন এসেছে অথবা বাসায় গেছে।
একজন বলেছেন, ঘটনার বিষয়ে কেউ তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করেননি। তারা সবাই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।
এদিকে বার্নিকাটের গাড়িতে হামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দাবি করে বসেন, সোর্সের মাধ্যমে তিনি আসামিদের মনের অভিপ্রায় জানতে পেরেছেন। আবার এক আসামি যখন বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা আবদুর রউফ তাকে ফোন করেছিলেন, তখন তিনি তা অস্বীকার করেন।
তিনি আরও দাবি করে বসেন, আসামিদের তিনি ধরার চেষ্টা করেছেন কিন্তু পারেননি। যদিও তারা সবাই নিজের এলাকাতেই রয়েছেন, অথচ বিস্ময়করভাবে তাদের ধরতে পারছে না পুলিশ।
কাদের বাঁচাতে চাইছে পুলিশ
হামলার দিন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের ইকবাল রোডের ১২/২ নম্বর বাড়িতে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট ছাড়াও ড. কামাল হোসেন, তার স্ত্রী হামিদা হোসেন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দিন আহমেদসহ বেশ কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। তখন রাজধানীসহ সারা দেশে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন চলছিল।
এ সময় বদিউল আলমের বাড়িতেও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। দলটি বাড়ির জানালার গ্লাস ভাংচুর করে বদিউল আলম, তার স্ত্রী ও ছেলে মাহবুব মজুমদারকে জীবননাশের হুমকি দেয়। মাহবুবকে ধাক্কা দিয়ে আঘাত করেন। বাড়ির প্রধান গেট ধাক্কাধাক্কি করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে তারা চলে যান।
তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গাড়িবহরের ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাটি একটি ফৌজদারি অপরাধ। বিএনপির শাসনামলে জঙ্গিরা তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর বোমা হামলা চালিয়ে তাকে গুরুতর আহত করেছিল। আর মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ওপর হামলার ঘটনা ঘটিয়েছেন আওয়ামী লীগেরই স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। তো স্পষ্টতই এই তদন্তে পুলিশকে পক্ষপাতহীন আশা করা, বোকার স্বর্গে বসবাসের সামীল।
কোন প্রকার প্রমাণাদি ছাড়াই পুলিশের তদন্তে ঘটনাটিকে বলা হয়েছে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র। হামলার প্রকৃত দোষীদের পিঠ বাঁচাতেই এই মিথ্যাচার চালাচ্ছে।
কিন্তু পুলিশের এই ধারণার ওপর ভিত্তি করেও কোনো নাগরিক বিদেশি রাষ্ট্রদূতের গাড়িবহর কিংবা অপর কোনো নাগরিকের বাড়িতে হামলা চালিয়ে পার পেয়ে যেতে পারে না।
সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের প্রবেশ, তল্লাশি ও আটক হইতে স্বীয় গৃহ নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকিবে বলে সংবিধানে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।’
আন্তর্জাতিকভাবে হতে হচ্ছে প্রশ্নের সম্মুখীন
মন্ত্রী-মিনিস্টাররা যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলে বার্নিকাটের মামলার ভাগ্য নিয়ে তাদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়, নানা কথা শুনতে হয়। একটি সৃজনশীল তদন্তপদ্ধতি বের করা ছাড়া দুদক বা পুলিশের তদন্তকারীদের আর কীই-বা করার ছিল!
যুক্তরাষ্ট্র সরকার মার্শা বার্নিকাটের গাড়ির ওপর হামলার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে কয়েকবারই বাংলাদেশের কাছে জানতে চেয়েছে। তারা এ বিষয়ে কার্যকর ও নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময়ও মার্কিন কর্মকর্তারা ওই হামলার ঘটনার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় ফিরে ওই হামলার তদন্ত নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু আখেরে কোন লাভ হয়নি। প্রায় ৩ বছর পার হতে চলল। রহস্যময়ভাবে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা তো দূরের কথা, এমন স্পর্শকাতর একটি তদন্ত যেন কচ্ছপের পিঠে চড়ে বসেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে একজন বিদেশি রাষ্ট্রদূতের গাড়িতে হামলার ঘটনাকে সাধারণ অপরাধ হিসেবে দেখলে ঠিক হবে না। এর সঙ্গে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও মর্যাদার প্রশ্নটিও জড়িত। অতিথিপরায়ণ হিসেবে বহির্বিশ্বে যে বাংলাদেশের সুনাম আছে, সেই বাংলাদেশকে যারা লজ্জায় ফেলেছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। সরকার একজন রাষ্ট্রদূতের গাড়িতে সন্ত্রাসী হামলা ঠেকাতে পারেনি। অন্তত হামলাকারীদের শাস্তি দেওয়া হোক। এই অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি না হলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির কী হবে, তা নিশ্চয়ই সরকারের নীতিনির্ধারকদের অজানা নয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৩১
আপনার মতামত জানানঃ