এখন থেকে আর কোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রম করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রাখাইন ভিত্তিক বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। তাই তাদেরকে সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে মিয়ানমারের সামরিক সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার (১১ মার্চ) থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হচ্ছে বলে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।
গত বছর সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) দলীয় সরকার আরাকান আর্মিকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিল। দীর্ঘ এক বছর ধরেই আরাকান আর্মি একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তালিকায় বন্দি ছিলেন। এবার এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করলো কদিন আগে সু চির সরকারকে উৎখাত করে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল নেওয়া সামরিক বাহিনী।
মিয়ানমারের সন্ত্রাসবিরোধী কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এখন থেকে আর কোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রম করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আরাকান আর্মি। একইসঙ্গে তারা দেশজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে রাজি হয়েছে। তাই সরকারি কাউন্সিল তাদের ওপর থেকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তকমা সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা আজ বৃহস্পতিবার (১১ মার্চ) থেকে কার্যকর হচ্ছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, এই গোষ্ঠীটি হামলা চালানো বন্ধ করেছে এবং দেশজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে রাজি হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার জানিয়েছে মিয়ানমারের রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম।
কারা এই আরাকান বাহিনী
১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত নেত্রী অং সান সু চিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর সৃষ্ট বিক্ষোভ সামাল দিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে প্রায় প্রতিদিনই সংগ্রাম করতে হচ্ছে, এর মধ্যেই এ সিদ্ধান্ত নিল দেশটির সামরিক জান্তা।
আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই করছে। গত দুই বছরে বিদ্রোহী এ গোষ্ঠীটি মিয়ানমারের বিদ্রোহী বাহিনীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সমীহ জাগানো নাম হয়ে উঠেছে। দেশটির সেনাবাহিনী প্রায় ৭০ বছর ধরে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর বিদ্রোহী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে।
মূলত আরাকান আর্মির অধিকাংশ সদস্য এসেছেন নৃতাত্ত্বিক বৌদ্ধ গোষ্ঠীগুলো থেকে। সাম্প্রতিক এসব সহিংসতায় রাখাইনে মারাত্মক নৃতাত্ত্বিক বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে, যা রাজ্যটিতে দীর্ঘদিন ধরে বড় ধরনের ক্ষতের জন্ম দিয়েছে।
রাখাইনে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে এক দশক আগে আরাকান আর্মি গঠিত হয়েছে। বিচ্ছিন্ন কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে তারা শোষিত হচ্ছেন বলে দাবি করে আসছিল সংগঠনটি।
শুরুর দিকে তাদের অনেক সদস্য রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্য থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। এসব বৌদ্ধ জেড পাথরের খনিতে কাজ করে ভাগ্য নির্ধারণে উত্তর মিয়ানমারে গিয়েছিলেন।
চীনের সঙ্গে মিয়ানমার সীমান্তে তাদের জড়ো করে প্রশিক্ষণ দিয়েছে কাচিন মুক্তি বাহিনী (কেআইএ)। এ সংগঠনটিই অত্র অঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তার করছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া সবচেয়ে বড় নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী হচ্ছে কাচিনরা।
২০১৬ সালের শেষ দিক থেকে শান রাজ্যে উত্তরাঞ্চলীয় জোটের অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কাচিনদের পাশাপাশি লড়াইয়ে নেমেছিল আরাকান আর্মির যোদ্ধারা।
ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তের পশ্চিমাঞ্চলীয় পাহাড়ি অঞ্চলেও চলাচল রয়েছে আরাকান আর্মির। সেখানে তাদের তিন হাজার সদস্য রয়েছে বলে মনে করা হয়।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান
এদিকে মিয়ানমারের সামরিক সরকার আরাকান আর্মিকে সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দিলেও তাদের ওপরই নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সিনিয়র নেতা ও দেশটির রাজস্বের প্রধান উৎসের ওপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার তদন্ত কর্মকর্তা টমাস অ্যান্ড্রু। এর মধ্যে রয়েছে দখলকারী সামরিক কর্তৃপক্ষ এবং সামরিক বাহিনীর মালিকানাধীন মিয়ানমার অয়েল অ্যান্ড গ্যাস এন্টারপ্রাইজ।
তিনি বলেন, ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে এর বিরুদ্ধে চলমান বিক্ষোভ দমাতে কমপক্ষে ৭০ জনকে ‘হত্যা’ করেছে ক্ষমতা দখলকারী জান্তা। বিক্ষোভ দমনে সামরিক বাহিনীর এই ‘খুন, নির্যাতন ও হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ড’ মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাকে অ্যান্ড্রু বলেন, নিহতদের অর্ধেকের বেশির বয়স ২৫ বছরের কম। সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর ২ হাজারের বেশি মানুষকে বেআইনিভাবে আটক করা হয়েছে এবং প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বেড়েই চলছে।
তিনি বলেন, মিয়ানমার নামের দেশটি খুনি ও অবৈধ শাসকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা বিক্ষোভকারী, চিকিৎসাকর্মী ও পথচারীদের নির্মমভাবে মারধর করেছে- এমন ঘটনার বিস্তৃত ভিডিওচিত্র প্রমাণ হিসেবে রয়েছে।
এদিকে, টমাস অ্যান্ড্রুসের এই বক্তব্য প্রচারের কয়েক ঘণ্টা পরেই তা নাকচ করে দিয়েছে জান্তা সরকার। মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব চ্যান আয়ে এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ সংযমের পরিচয় দিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আরাকান আর্মিকে সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দিলেও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ওপর সন্ত্রাসী কার্যক্রম করার যে ট্যাগ দেওয়া হয়েছে, এ থেকে পরিত্রাণ মোটেও সম্ভব নয়। কেননা, সু চি সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করলেও মূলত বিশ্ববাসীর বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়ে গেছে সেনাবাহিনী। ইতিমধ্যে বিশ্বের অনেক দেশই মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসাবেই আখ্যায়িত করেছে। আরাকান আর্মিকে দিয়ে তাদের পরিত্রাণ খুঁজলেও কোনো পথ নেই বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০৮
আপনার মতামত জানানঃ