পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের নোটাবেঁকী টহল ফাঁড়ির (অভয়ারণ্য কেন্দ্র) প্রধান আব্দুল্লাহ আল বাহারাম হোসেনের বিরুদ্ধে নিজের মেহমানদের হরিণের মাংস দিয়ে মেহমানদারি করার অভিযোগ উঠেছে। হরিণ মেরে ভুরিভোজ করার ঘটনা জানাজানি হওয়ায় সাতক্ষীরা রেঞ্জের নোটাবেঁকী টহল ফাঁড়ির (অভয়ারণ্য কেন্দ্র) প্রধান আব্দুল্লাহ আল বাহারাম হোসেনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে টহলের দায়িত্বে থাকা অপর তিনজনকে বিভিন্ন স্থানে বদলী করা হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার (৯ মার্চ) সকালে সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ঘটনায় বিষয়ে আরও তদন্ত চলছে। কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অভিযোগের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে টহলের দায়িত্বে থাকা অপর তিনজনের বিষয়ে তদন্ত চলছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
জানা গেছে, গত ১ মার্চ সোমবার বহিরাগত কয়েকজন পশ্চিম সুন্দরবনের নোটাবেঁকী অভয়ারণ্য কেন্দ্রে বেড়াতে যান। ওই কেন্দ্রের ইনচার্জ আব্দুল্লাহ আল বাহারামের পরিচিত ও নিকটাত্মীয় এসব মেহমানদের আতিথেয়তা করতে অভয়ারণ্য এলাকা থেকে হরিণ শিকার করে খাওয়ানো হয়। বিষয়টি একই কেন্দ্রে বোটম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনরত ফজলুল হক তার মোবাইলে গোপনে ধারণ করে বিভাগীয় বন সংরক্ষকের দপ্তরে পৌঁছে দেন।
ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর বিভাগীয় বন সংরক্ষকের নির্দেশে সাতক্ষীরা রেঞ্জের এসিএফের নেতৃত্বে তিনটি স্টেশন অফিসারের সমন্বয়ে একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য মতে, আব্দুল্লাহ আল বাহারামের নেতৃত্বে রাসেল মিয়া, কালু মিয়া, আব্দুর রাজ্জাক, বাদশা মিয়া, চন্দন কৈরী ও ফজলুল হক পশ্চিম সুন্দরবনের নোটাবেঁকী অভয়ারণ্য এলাকার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। আব্দুর রাজ্জাকসহ দুইজন প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত কাজে বাইরে থাকার সুযোগে অন্যরা নিজেদের সুরক্ষার কাজে ব্যবহৃত বন্দুক দিয়ে হরিণটি শিকার করে।
এদিকে অভয়ারণ্য কেন্দ্র প্রধান ছাড়া অন্য কারও বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় বন কর্মীদের অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর বিভাগীয় বন সংরক্ষকের নির্দেশে সাতক্ষীরা রেঞ্জের এসিএফ এর নেতৃত্বে তিনটি স্টেশন অফিসারের সমন্বয়ে একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়।
ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এম এ হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, ইতোমধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন বিভাগীয় বন সংরক্ষকের কাছে পাঠানো হয়েছে। অভয়ারণ্য কেন্দ্রের ইনচার্জের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। এছাড়া কেন্দ্রে দায়িত্বরতদের অন্যান্য স্টেশনে বদলী করা হয়েছে।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে আব্দুল্লাহ আল বাহারাম বলেন, এমন কোন ঘটনা ঘটেনি। বরং আমি অসুস্থ হয়ে ছুটি নিয়ে বাড়িতে ফেরার পর আজগুবি এসব অভিযোগ তুলে আমাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। বনকর্মীদের মধ্যে দলাদলির কারণে তাকে বৃহৎ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ফাঁসানো হচ্ছে বলেও দাবি তার।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনে হরিণ শিকার হঠাৎ করেই উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। বনবিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে, আবার কখনও তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে চুরি করে বনে ঢুকে শিকারিরা ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করছে। বিভিন্ন ধরনের সুবিধা নিয়ে শিকারিদের সুযোগ করে দিচ্ছেন কিছু অসাধু বন কর্মকর্তা, পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিরাও। তারা শিকারি চক্রের কাছ থেকে হরিণের মাংসসহ আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করায় দিন দিন সুন্দরবনে হরিণ শিকার বাড়ছে।
তারা বলছেন, বনবিভাগের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের খুশি করতে ও তদবির হিসেবে হরিণের মাংস সরবরাহ করে থাকে শিকারিরা। এসব কারণেই প্রধানত লোকালয়ের অনেক লোকই হরিণ শিকারকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। শিকারিদের বনবিভাগের লোকজন চেনে। কিন্তু তাদের কখনও গ্রেফতার করে না।’
তারা বলেন, অভয়ারণ্য কেন্দ্রের দায়িত্বে থেকে নিজের আত্মীয়-স্বজনদের হরিণের মাংস দিয়ে ভুরিভোজের ঘটনা থেকেই বোঝা যায় তারা কেমন দায়িত্ব পালন করছেন। প্রশাসনের লোকজনের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ সুবিধার জন্যই বন থেকে হরিণের সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। একদিকে তারা অসাধু হরিণ শিকারিদের সুযোগ করে দিচ্ছে অন্যদিকে নিজেরাই সেই সুযোগ গ্রহণ করে সুবিধা নিচ্ছে। অসাধু হরিণ শিকারিদের আগে দায়িত্বরত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সমূহ আমলে নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে বনের হরিণ রক্ষা সম্ভব বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৩
আপনার মতামত জানানঃ