আফাগানিস্তানে আবারও সাংবাদিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে। দেশটিতে গণমাধ্যমকর্মীদের লক্ষ্য করে প্রায়ই হত্যার ঘটনা ঘটে। গত মঙ্গলবার(০২ মার্চ) দেশটির আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ নাঙ্গারহারের রাজধানী জালালাবাদে তিন নারী সাংবাদিককে গুলি করে হত্যার করা হয়েছে। অফিস থেকে পায়ে হেঁটে বাড়িতে ফেরার সময় তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। তবে এ হত্যার দায় স্বীকার করেছে উগ্র সন্ত্রাসীগোষ্ঠী আইএস। জঙ্গি সংগঠনগুলোর তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্সকে উদ্ধৃত করে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ তথ্য জানিয়েছে।
সন্ত্রাসী সংগঠন আইএসের স্থানীয় সহযোগী একটি সংগঠন ওই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে বলেছে, ওই তিন সাংবাদিক আফগান সরকারের প্রতি অনুগত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে কাজ করছিলেন। তাই তাদের হত্যা করা হয়েছে।
গত মঙ্গলবার (২ মার্চ) বন্দুকধারীর হামলায় নিহত তিন গণমাধ্যমকর্মী হলেন মুরশাল ওয়াহিদি,শাহনাজ ও সাদিয়া। তাদের বয়স ১৮-২০ বছরের মধ্যে। তিন নারীই জালালাবাদের বেসরকারি টিভি চ্যানেল এনিকাসে ডাবিং বিভাগে কাজ করতেন। এ ছাড়া এই হামলায় আরও এক নারী সাংবাদিক আহত হয়েছেন। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন তিনি।
চ্যানেলের পরিচালক জালমাই লতিফ জানিয়েছেন,ওই কর্মীরা কাজ সেরে টিভি স্টেশন থেকে বের হওয়ার পর ওই ঘটনা ঘটে। তিনি বলেছেন,তিনজনই অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। আলাদাভাবে চালানো দুই হামলায় তারা ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আহত হওয়া চতুর্থ নারীকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
বার্তা সংস্থা এপির মতে, নিহতদের মধ্যে মুরসাল ওয়াহিদি হেঁটে বাড়ি যাওয়ার সময় তার ওপর অস্ত্রধারীরা হামলা চালায়। অন্য নিহত দু’জনকে শুধু শাহনাজ এবং সাদিয়া নামে শনাক্ত করা গেছে। তারা বাড়ি ফেরার পথে আলাদা হামলায় নিহত হয়েছেন।
প্রধান সন্দেহভাজনকে আটকের পর পুলিশ দাবি করেছিল সে তালেবান সদস্য। তবে তালেবান হামলার দায় অস্বীকার করেছিল।
সাইট ইন্টেলিজেন্স জানিয়েছে বুধবার আইএস-এর পক্ষ থেকে হামলার দায় স্বীকার করে বলা হয়েছে, তাদের যোদ্ধারাই ওই গণমাধ্যমকর্মীদের হত্যা করেছে।
সম্প্রতি আফগানিস্তানজুড়ে সাংবাদিক, সমাজকর্মী, সরকারি কর্মীদের বেছে বেছে হত্যা করা হচ্ছে। তার মধ্যে অনেকেই নারী। ভয়ের পরিবেশ তৈরির জন্য এই কাজ করা হচ্ছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর আগে গত ডিসেম্বরে এনিকাস চ্যানেলের একজন নারী কর্মীকে আইএসের সঙ্গে যুক্ত সংগঠন হত্যা করেছিল। চ্যানেল এনিকাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের প্রতিষ্ঠানে ১০ জন নারী কাজ করতেন। এর মধ্যে এ পর্যন্ত চারজনকে হত্যা করা হয়েছে।
এ নিয়ে দেশটিতে গত তিন মাসে কমপক্ষে ৮ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হলো। গত তিন মাসে যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তারা হলেন গজনি জার্নালিস্ট ইউনিয়নের প্রধান রহমতুল্লাহ নেকজাদ। তাকে গত মাসে শহরের পূর্বাঞ্চলে বাড়ির কাছে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এর কয়েকদিন আগে এনিকাস টিভি এবং রেডিওর একজন সাংবাদিক মালালা মাইওয়ান্ডকে কাজে যাওয়ার পথে তার গাড়িতে গুলি করে হত্যা করে অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা। নভেম্বরে সুপরিচিত টেলিভিশন উপস্থাপক ইয়ামা সাইওয়াশকে হত্যা করা হয়েছে। কাবুলে তার বাড়ির কাছে তার গাড়িতে বেঁধে রাখা বোমা বিস্ফোরিত হয়ে তিনি ও অন্য দু’জন নিহত হয়েছেন। রেডিও লিবার্টির রিপোর্টার আলিয়াস ডাইয়িকে নভেম্বরে লস্করগাঁতে গাড়িতে পেতে রাখা বোমা বিস্ফোরণে হত্যা করা হয়েছে। আফগানিস্তানের প্রথম নারী চলচ্চিত্র পরিচালক সাবা সাহার’কে কাবুলে গুলি করা হয়েছে। তবে তিনি এতে বেঁচে গেছেন। এছাড়া গত মাসে রাজধানী কাবুলে সুপ্রিম কোর্টের দু’জন নারী বিচারপতিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
কয়েক মাস আগেও বিসমিল্লাহ আদেল আইমাককে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছিল। তিনি আফগানিস্তানের সংবাদ জগতে পরিচিত মুখ। বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি মানবাধিকারকর্মী হিসেবে কাজ করছেন।
এক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার নিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন তালেবানের সঙ্গে। তারপর থেকে দেশটিতে এমন টার্গেট করে হামলা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফেব্রুয়ারিতে বিবিসির কাছে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণি বলেছিলেন, তালেবানের উত্থান নিয়ে তিনি আতঙ্কিত নন। তার ভাষায়, তার সরকার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে না। ফেব্রুয়ারিতে ন্যাটো বলেছে, তারা এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি যে, মে নাগাদ তাদের সেনা প্রত্যাহার করা হবে কিনা। তবে এই সময়ের মধ্যে সেনা প্রত্যাহারে তারা সম্মত হয়েছিল তালেবানদের সঙ্গে চুক্তিতে। এখনও আফগানিস্তানে অবস্থান করছে প্রায় ৯ হাজার ন্যাটো সেনা। এর মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার মার্কিন সেনা। তাদেরকে আফগানিস্তানে রাখা না রাখা নিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে চুক্তি করেছিলেন, তা নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বহাল রাখবেন কিনা সে বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নেননি।
আন্তর্জাতিক মানবধিকারকর্মীরা বলেন, তালেবান শাসিত আফগানিস্তান এখন হত্যা খুনের অভয়ারণ্য তৈরী হয়েছে। দেশটিতে সাংবাদিক, মানবধিকারকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও নিরাপদ নয়। যে কোনো ছাল-ছুতোয় খুন করার সুযোগ খোঁজে। তারা মনে করেন, দেশটিতে যেমন নেই কথা বলার স্বাধীনতা, তেমনি বেঁচে থাকার স্বাধীনতাও ক্ষীণ হয়ে আসছে।
তারা জানান, তালেবান শাসিত আফগানিস্তানে কেবল নারীরাই অনিরাপদ নয়, মুক্তচিন্তার অধিকারী প্রত্যেকেই তাদের গুলির আওতাভুক্ত। পান থেকে সামান্য একটু চুন খসে পড়লেই তাদের হাত থেকে কেউ রেহাই পাচ্ছে না। নারী শিশু দুর্বল প্রতিবন্ধী কোনো বাছ বিচার নেই তাদের বন্দুকের নলা থেকে বেরিয়ে আসা গুলির। সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করে থাকেন, এভাবে চলতে থাকলে দেশটি পৃথিবীর মানচিত্র থেকে একদিন জনশূন্যতার কারণে বিলীন হয়ে যেতে পারে, সেখানে মৃত্যুর আখড়া ব্যতিত অন্যকিছু টিকে থাকার সম্ভাবনা মুছে যাবে। অনেকে মনে করেন, দেশটি ইতিমধ্যেই সেই কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১৮
আপনার মতামত জানানঃ