ভারতের শতাধিক মাদ্রাসায় হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে দেশটির বিজেপি সরকার। নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতির আওতায় দেশটির শতাধিক মাদ্রাসায় গীতা, বেদ বা রামায়ণের মতো হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ১০০ মাদ্রাসায় এগুলো পড়ানো শুরু করা হবে। পরবর্তীতে ৫০০ মাদ্রাসায় তা চালু করা হবে। তবে দেশটির শিক্ষাবিদরা অনেকেই এই পদক্ষেপে চিন্তিত।
প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞান ও পরম্পরা’ নামে নতুন একটি বিষয় চালু করে তৃতীয়, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রদের এগুলো পড়ানো হবে বলে দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সংস্থা জানিয়েছে।
দ্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ওপেন স্কুলিং বা এনআইওএস, ভারতের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি স্বশাসিত সংস্থা। তারাই নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাস্তবায়ন করছে।
ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম টাইমস অফ ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, কেন্দ্রের নতুন শিক্ষানীতি মেনেই এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ওপেন স্কুলিংয়ের চেয়ারম্যান সরোজ শর্মা জানিয়েছেন, আপাতত ১০০টি মাদরাসায় তৃতীয়, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যক্রমে থাকছে গীতা-রামায়ণ। ভবিষ্যতে ৫০০টি মাদরাসায় চালু হবে এই বিষয়ে পাঠদান।
ওই নতুন প্রস্তাবে ১৫টি নতুন কোর্সের কথা বলা হয়েছে। ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে এই তালিকায় রাখা হতে পারে বেদ, যোগ, রামায়ণ এবং মহাভারত। এছাড়াও থাকছে সংস্কৃত ভাষাও। এরই সঙ্গে থাকবে কিছু ভোকেশনাল স্কিলও। পড়ানো হবে ভগবত গীতাও।
গতকাল মঙ্গলবার(২ মার্চ) ভারতের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল দাবি করেন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ওপেন স্কুলিংয়ের নতুন এই প্রস্তাব মাদ্রাসা ও আন্তর্জাতিক পড়ুয়াদের ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বুঝতে সাহায্য করবে।
রমেশ পোখরিয়াল বলেন, আমাদের বেদ-পুরাণ-উপনিষদ যে সংস্কৃতির শিক্ষা আমাদের দিয়েছে, তা অমূল্য। এই সুফলকে আমরা মাদ্রাসাগুলোতে, এমন কী দেশের বাইরেও ভারতীয়দের কাছে ছড়িয়ে দিতে চাই। ফলে এনআইওএসের এই পদক্ষেপকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই।
কিন্তু এই পদক্ষেপ মাদ্রাসাগুলোতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে কি না, তা নিয়ে শিক্ষাবিদরা অনেকেই রীতিমতো সন্দিহান।
বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়েছে, দিল্লিতে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ অধ্যাপক অমরিন্দর আনসারি বলেছেন, “প্রথমত মাদ্রাসাগুলো কিন্তু সংগঠিত শিক্ষা খাতের ভেতরে পড়ে না। সেখানে একটা বহুত্ববাদী সংস্কৃতির দেশে এরকম কিছু চালু করতে গেলে সেটা কিন্তু জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হিসেবেই দেখা হবে। মাদ্রাসাগুলোর স্বশাসনেরই বা কী হবে?
তিনি আরও বলেন, হ্যাঁ, বেদ-গীতা-রামায়ণের বদলে যদি ‘ভারতীয় ধর্ম’ বলে একটা বিষয় চালু করা হত, যেখানে দেশের সব ধর্মের শিক্ষাই থাকবে, সেটা হয়তো মেনে নেওয়া যায়। মাথায় রাখতে হবে, ধর্ম আর ধর্মগ্রন্থ কিন্তু দুটো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।
তবে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সর্বভারতীয় নেতা সুরেন্দ্র জৈন সরকারের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, গীতা-রামায়ণ-বেদকে আসলে শুধু হিন্দু ধর্মগ্রন্থ হিসেবে দেখাটাই ভুল। কারণ এই গ্রন্থগুলো বিশ্বজনীন মানবতার কথা বলে।
তিনি বলেন, আমরা মনে করি, এই গ্রন্থগুলো যে মূল্যবোধের শিক্ষা দেয় তা পড়ানোটা ভারতে বসবাসকারী প্রত্যেকের জন্য বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।
অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় নাজবুল হক হাই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মহম্মদ আলাউদ্দিন ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, এই সব গ্রন্থে আপত্তিকর কিছু নেই।
সেই সঙ্গে তিনি বলেন, তারা মাদ্রাসায় বাধ্যতামূলকভাবে কোনও ধর্মশিক্ষা দেন না— ফলে জোর করে কোনও ধর্মীয় শিক্ষা চাপিয়ে দিতে গিলে ফল ভাল না-ও হতে পারে। যেমন আরবি পড়ানো হয় একটা ভাষা হিসেবে, এখানে ধর্মের কোনও ব্যাপার নেই। এমনকি কেউ চাইলে আরবি নিতেও পারে, কেউ আবার না-ও নিতে পারে। এটা ছাত্রদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেই জায়গায় পাঠ্যক্রমে ধর্মগ্রন্থ নিয়ে এলে সমস্যা হতেও পারে, আবার না-ও হতে পারে।
এনআইওএস অবশ্য আশ্বাস দিয়েছে, মাদ্রাসার কোনও ছাত্রকেই জোর করে কোনও বিষয় নিতে বাধ্য করা হবে না।
এর আগে গত ডিসেম্বরে ভারতের আসামে ৭০০টিরও বেশি সরকারি মাদ্রাসা বন্ধ করে এগুলোকে সাধারণ বিদ্যালয় হিসেবে চালু করতে রাজ্যের বিধানসভায় একটি বিল পাস হয়েছে। এর আগে আসাম মন্ত্রিসভা সব মাদ্রাসা ও সংস্কৃত বিদ্যালয় বন্ধ করার প্রস্তাব অনুমোদন দেয়।
২০২০ সালের জুলাই মাসে প্রায় ৩৪ বছর পর বদল আসে ভারতের নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে। এক সাংবাদিক সম্মেলন করে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে এই পরিবর্তনের কথা ঘোষণা করা হয়। নতুন নীতিতে শিক্ষার অধিকারের আওতায় আনা হয়েছে ৩ থেকে ১৮ বছরের শিক্ষার্থীদের। পাশাপাশি বদল ঘটানো হয়েছে পরীক্ষা ব্যবস্থায়। এমনকী আমূল বদলে গিয়েছে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাও। মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের নাম বদলে হয়েছে শিক্ষামন্ত্রণালয়। স্বাধীনতার পর থেকে এই নামেই পরিচিত ছিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে গুরুত্বহীন দশম বা দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের মুখস্থ বিদ্যার বদলে হাতেকলমে শিক্ষায় জোর দেয়া হবে। প্রতিবছরের বদলে তৃতীয়, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পরীক্ষা নেয়ার সুপারিশ করা হয়। দশম শ্রেণির পর কলা বিভাগ, বিজ্ঞান বিভাগ বা বাণিজ্য বিভাগের তফাৎ উঠে যাচ্ছে। পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়লেও, পাঠ্যক্রমে থাকতে পারে সংগীত। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন নিয়ে পড়লেও, ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়ার সুযোগ পাবে শিক্ষার্থীরা। যদিও বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, নতুন নীতিতে শিক্ষাব্যবস্থা কুক্ষিগত করেছে মোদি সরকার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১৩১
আপনার মতামত জানানঃ