পূর্বঘোষণা ছাড়াই বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে পাঁচতারকা হোটেল ও বিনোদনকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদে লংমার্চ করেছেন ম্রো সম্প্রদায়ের সদস্যরা। রোববার (৭ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৯টার দিকে চিম্বুকের রামরি পাড়া থেকে লংমার্চ শুরু হয়। প্রায় ৩০ কিলোমিটার হেঁটে আসার পর শহরের ঐতিহ্যবাহী বোমাং রাজার মাঠে সমাবেশ করেন ম্রোরা। এতে প্রায় দেড়হাজার নারী-পুরুষ অংশ নেন।
পূর্বঘোষণা ছাড়াই রোববার এ লংমার্চের আয়োজন করে ম্রো আদিবাসীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন, এমনকি গণমাধ্যমকর্মীরাও লংমার্চের বিষয়ে কিছু জানতেন না। আকস্মিক এই লংমার্চে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। ম্রো জনগোষ্ঠীর কয়েক হাজার মানুষ চিম্বুক থেকে বান্দরবান শহরে যাওয়ার পথে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বৈথানি পাড়া ছয় মাইল এলাকায় পুলিশের বাধার মুখে পড়ে তারা। বাধা অতিক্রম করেই বোমাং রাজার মাঠে এসে লং মার্চ শেষ হয়।
বান্দরবানের নীলগীরি’র নাইতং পাহাড় এলাকার চন্দ্র পাহাড় নামক স্থানে সিকদার গ্রুপ পাঁচ তারকা মানের হোটেল তৈরি করার কাজ শুরু করেছে, আর ম্রো জনগোষ্ঠী জনসাধারণ শুরু থেকেই তাদের জমি দখলের অভিযোগসহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে এই পাঁচ তারকা মানের হোটেল বন্ধের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে।
ম্রোদেরা লংমার্চে পাঁচটি দাবি উত্থাপন করেন। সেগুলো হলো- চিম্বুকের নাইতং পাহাড়ের পাঁচতারকা হোটেল ও বিনোদনকেন্দ্র স্থাপনের প্রকল্প বাতিল করতে হবে। অবৈধভাবে ভূমি দখলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী স্থানীয় পাড়াবাসী, জনপ্রতিনিধি, ছাত্র জনতাকে হয়রানি ও হুমকি প্রদান করা বন্ধ করতে হবে। চিম্বুকের ম্রোদের বংশপরম্পরায় ভোগদখলীয় ভূমিতে কোনো ধরনের পর্যটন বা বিনোদনকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। স্থানীয় মানুষের ভূমি দখল করে পর্যটনকেন্দ্র সম্প্রসারণ উদ্যোগ কোনোভাবেই গ্রহণ করা যাবে না। যে উদ্দেশ্যেই চিম্বুক পাহাড়ের ভূমি ব্যবহার করা হোক না কেন, তা স্থানীয় কারবারি, হেডম্যান, জনপ্রতিনিধি ছাড়াও চিম্বুক পাহাড়ের সব পাড়াবাসীকে অন্তর্ভুক্ত করে আলোচনা করতে হবে।
এক বিজ্ঞপ্তিতে চিম্বুক পাহাড়বাসীরা জানান, ম্রোদের ভূমি বেদখল করে চিম্বুকের নাইতং পাহাড়ে সিকদার গ্রুপ (আর অ্যান্ড আর হোল্ডিংস) ‘ম্যারিয়ট হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস’ নামে একটি পাঁচতারকা হোটেল ও বিনোদনকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এর ফলে আমাদের আনুমানিক এক হাজার একর ভোগদখলীয় ও চাষের জমি বেদখল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে আমাদের ছয়টি পাড়া সরাসরি উচ্ছেদের মুখে পড়বে এবং ১১৬টি পাড়ার আনুমানিক ১০ হাজার বাসিন্দার ঐতিহ্যবাহী জীবিকা, চাষের ভূমি, ফলজ বাগান, পবিত্র জায়গা, শ্মশান ঘাট ও পানির উৎসগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সংরক্ষিত পাড়াবন ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে। এই জবরদস্তি ভূমি বেদখলের প্রতিবাদে ও নিজেদের বংশ পরম্পরায় আবাসকৃত ভূমিতে স্ব স্ব জীবন ব্যবস্থা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকারের দাবিতে আমরা গত বছরের ৭ অক্টোবর জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি স্মারকলিপি প্রদান করেছি। ৮ নভেম্বর চিম্বুক পাহাড়ে কালচারাল শোডাউনের মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছি। এ-সত্ত্বেও হোটেল নির্মাণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকায় গত ১১ ডিসেম্বর চিম্বুক পাহাড়বাসী চিম্বুকস্থ কাপ্রু পাড়ায় এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, এই বেআইনি কার্যক্রমের বিরুদ্ধে দেশের সব প্রান্তের প্রগতিশীল নাগরিকবৃন্দ, সচেতন ছাত্রসমাজসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এই প্রকল্প বাতিল করা ও চিম্বুকবাসীর জীবন-জীবিকা রক্ষার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করাসহ ছয়টি দাবি জানিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ও ১০৬ জন খ্যাতনামা ব্যক্তি, জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার কর্মী, অধ্যাপক, আইনবিদ, পরিবেশবিদ, ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সমর্থন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে চিঠি লিখেছে। গত বছর ১২ ডিসেম্বর দেশের বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ ও ভুক্তভোগী স্থানীয় মানুষ অনলাইনে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই হোটেল নির্মাণ বন্ধের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। দেশের ৬২ জন বিশিষ্ট নাগরিক ১৬ ডিসেম্বর ম্রো ভূমিতে বিনোদনকেন্দ্র নির্মাণ বাতিলের দাবিতে বিবৃতি দিয়েছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে এবং এই প্রকল্প বাতিলের আহ্বান জানিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে গত ২২ ডিসেম্বর চিঠি দিয়েছেন।
সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন পাড়াবাসী সিংপাত ম্রো, ছাত্রনেতা রেংইয়ং ম্রো। এছাড়া ম্রোদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের জেলা আহ্বায়ক জোয়াম লিয়ান আমলাই।
চিম্বুক পাহাড়ের বাসিন্দা রেংয়ং ম্রো বলেছেন, চিম্বুক ও নাইতংপাহাড়ের জমি আর ম্রোদের জীবন আলাদা করে ভাবা যায় না। হোটেল ও বিনোদন পার্কে প্রকল্প বাতিল করার জন্য প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বান্দরবানের নাইতং পাহাড়ের কাপ্রু পাড়া এলাকায় পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ করা হলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির ম্রো সম্প্রদায় ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং তারা তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাবে। পাহাড়ের সৌন্দর্য্য নষ্ট না করে পাহাড়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সুন্দরভাবে বসবাসের জন্য পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ বন্ধ রাখার জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৫২০
আপনার মতামত জানানঃ