বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান ড. এম. মোশাররফ হোসেন এফসিএ’র বিরুদ্ধে ঘুষ দাবির অভিযোগ করেছে বেসরকারি বীমা কোম্পানী ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স। রবিবার কোম্পানিটি’র প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাহী পরিচালক চৌধুরী কামরুল আহসান এ ধরণের অভিযোগ করেন। এদিকে প্রতারণার অভিযোগ তুলে ২০০ ধারায় ডেল্টা লাইফের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গত ১৭ জানুয়ারি মামলা করেছেন বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ড. এম. মোশাররফ হোসেন এফসিএ।
বিমা খাতের অন্যতম প্রভাবশালী কোম্পানি ডেল্টা লাইফ। ১৯৮৬ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৯৫ সালে শেয়ারবাজারে আসে। এর আগেও মামলা সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিলতায় দীর্ঘদিন কোম্পানির লভ্যাংশ আটকে ছিল। গতকাল রাজধানীর গুলশানে ডেল্টা টাওয়ারে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ তুলে ধরেন ডেল্টা লাইফের পরিচালক জীহাদ রহমান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আদিবা রহমান।
লিখিত বক্তব্যে ডেল্টা লাইফের নির্বাহী পরিচালক বলেন, আইডিআরএর বর্তমান চেয়ারম্যান যিনি এক সময় ডেল্টা লাইফের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। এজন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে ডেল্টা লাইফের ২০১৯ সালের একচ্যুরিয়াল ভ্যালুয়েশনের বেসিস অনুমোদন দেওয়া হয়নি। মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার নবায়ন অনুমোদন না দিয়ে এবং কোম্পানিকে নানা অজুহাতে অন্যায়ভাবে জরিমানা আরোপের হুমকি দিচ্ছেন আইডিআরএ চেয়ারম্যান। এছাড়া কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ বহিষ্কার করে প্রশাসক নিয়োগেরও হুমকি দিচ্ছেন বলে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়।
ঘুষের দাবির অভিযোগ তুলে কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক বলেন, বিভিন্ন বিষয় সমাধানের জন্য আইডিআরএর চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করতে গেলে তিনি কোম্পানির কাছে প্রথমে ২ কোটি, পরে ১ কোটি ও সর্বশেষ ৫০ লাখ টাকা উৎকোচ দাবি করেন। এ সংক্রান্ত অডিও ক্লিপ ও ট্রান্সক্রিপটি দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ আকারে দাখিল করা হয়েছে বলে তিনি জানান। পরে এ বিষয়ে হাইকোর্ট বিভাগ অধিকতর তদন্ত করার আদেশ দিয়েছে। তিনি জানান, আইডিআরএ চেয়ারম্যানের বিদ্বেষপূর্ণ আচরণের কারণে ডেল্টা লাইফ কোম্পানি নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। অবিলম্বে এ হয়রানি বন্ধ করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান কোম্পানির এ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মহিমুল ইসলাম মিল্টন, আইনি পরামর্শক ব্যারিস্টার আবুল কালাম আজাদ, নির্বাহী পরিচালক চৌধুরী কামরুল আহসান এবং যুগ্ম নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট আনোয়ারুল হক।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পরিচালক জীহাদ রহমান জানান, প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথম ডেল্টা লাইফের অ্যাকচুয়ারি ভ্যালুয়েশন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে ডেল্টা লাইফে স্পেশাল অডিট এবং ইনভেস্টিগেশন অডিট করা হয়েছে। এ কাজটি এমন একটি অডিট ফার্মকে দিয়ে করা হয়েছে, যেটির মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। ফার্মটি বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত অডিট ফার্মের তালিকায় স্থান পায়নি। এ ফার্মের তোলা আপত্তিগুলো ভিত্তিহীন। এ বিষয়ে আইডিআরএ থেকে ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে। শিগগির ওইসব অভিযোগ বা অনিয়মের ব্যাখ্যা দেওয়া হবে। তা ছাড়া অবৈধভাবে প্রশাসক নিয়োগের চেষ্টা করা হলে আইনিভাবে মোকাবিলা করা হবে বলেও জানান তিনি।
এ সময় ঘুষ দাবি করা সংক্রান্ত দুটি অডিও রেকর্ড সাংবাদিকদের শোনানো হয়। দু’বারই ডেল্টা লাইফের কর্মকর্তা আব্দুল আউয়াল আইডিআরএ চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেন। অডিওতে মোশাররফ হোসেনকে বলতে শোনা যায়, “…আমি নিজে যদি বলতাম, ঠিক আছে, আপনি যেই ১০ নিয়ে আসছিলেন, ওইটা নিয়ে আসেন আগে। আজকেই নিয়ে আসেন… আমি চাই যে, এটা ‘ইয়ে’ হোক, সলিউশন হোক।” একটি অডিওতে তিনি কোনো একজন ‘স্যার’-এর জন্য টাকা চান।
যোগাযোগ করা হলে ডেল্টা লাইফের এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথোপকথনের বিষয়ে আইডিআরএ চেয়ারম্যান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আপনারা যে অডিও শুনেছেন, একটি সংস্থা থেকে পেয়ে তা আমিও শুনেছি। এখানে পুরোটা নাই, আংশিক। পুরোটা শুনলে বুঝতেন তাদের অভিযোগ ঠিক নয়। কয়েকটি সংস্থায় এটি গেছে, তারা অভিযোগের প্রমাণ পায়নি।’
মোশাররফ হোসেন উল্টো অভিযোগ করেন, ব্যক্তিগত কারণে কোম্পানিটি বিভিন্নজনের মাধ্যমে তাকে হয়রানির চেষ্টা চালাচ্ছে। কিছু গণমাধ্যমেও রিপোর্ট করানো হয়। তিনি আরও বলেন, এরপর বিষয়টি সুরাহার চেষ্টা করি। তবে নিজের জন্য নয়। অবশ্য গতকাল রাতে ঘুষের টাকা নিয়ে যাওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন ডেল্টা লাইফের কর্মকর্তারা।
কথোপকথনে উল্লেখ থাকা এক ‘স্যার’-এর বিষয়ে জানতে চাইলে আইডিআরএ চেয়ারম্যান বলেন, কোম্পানিতে অনেক সমস্যা আছে, অনেক বঞ্চিত আছেন… তাদের অনেক খরচ হয়েছে … ওদের জন্যই একটি সমঝোতা করার চেষ্টা করেছি। আমি প্রথমে টাকা চাইনি, ওরাই ১০ লাখ টাকা নিয়ে এসেছিল। ওইদিন ঘুষ প্রস্তাবের কারণে আইনি ব্যবস্থা না দেওয়াই ভুল হয়েছে। দায়িত্বশীল পদে থেকে অডিট আপত্তির বিষয়ে ছাড় দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিষয়ে আইডিআরএ চেয়ারম্যান বলেন, ‘এটা ঠিক হয়নি।’ তিনি জানান, দুদকের কাছ থেকে ঘুষ দাবির অভিযোগের নথি পাওয়ার পর তিনি মানহানির মামলা করেছেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জীবন বীমা খাতের একটি প্রতিষ্ঠিত ও আর্থিকভাবে সচ্ছল কোম্পানিতে প্রশাসক নিয়োগের হুমকি খুবই দুঃখজনক ও হতাশার। এমনটি করা হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পুরো বীমা খাতে। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে আইডিআরএর দুর্নীতিগ্রস্ত নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তারা।
আপনার মতামত জানানঃ